• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
নির্বাচনবিহীন ৩০ বছর

পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের লোগো

ফাইল ছবি

জাতীয়

নামেই জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান

নির্বাচনবিহীন ৩০ বছর

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৫ মে ২০১৯

আজ থেকে ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালে পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের প্রথম ও একমাত্র নির্বাচন হয়েছিল। সে পরিষদের মেয়াদ ছিল তিন বছর। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রাষ্ট্রপক্ষ। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের অনুগতদের দিয়ে পাহাড়ের মন্ত্রণালয় খ্যাত জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া চলমান জেলা পরিষদগুলো জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি মোতাবেক জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও কার্যক্রম অনির্বাচিত লোকদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় বিভাগগুলোর মাধ্যমে জনগণের জন্য দেওয়া সরকারি সেবা ও সুযোগ-সুবিধা একটি বিশেষ গোষ্ঠী ভোগ করে নিচ্ছে। ফলে সাধারণ জনগণ এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে কার্যকর কোনো সুফল পাচ্ছে না। পাহাড়ের সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, জনগণের নিকট দায়বদ্ধহীন অনির্বাচিত লোকদের দিয়ে জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের আস্থার প্রতীক হতে পারেনি।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে পার্বত্য জনগণের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে এমন প্রত্যাশা ছিল পাহাড়বাসীর। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) অভিযোগ, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলা পরিষদ নিয়েও জনগণের কম প্রত্যাশা ছিল না। অথচ যে সরকার ক্ষমতায় আসে সে সরকারের মনোনীত ব্যক্তিরাই জেলা পরিষদের আসনে বসেন। ফলে সেখানে পার্বত্য জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নয়, দলীয় ইচ্ছার প্রতিফলনই ঘটছে। নির্বাচিত পরিষদ না হওয়ায় জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেনি জেলা পরিষদ। চুক্তি বাস্তবায়নে নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলো জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠুক, এমন প্রত্যাশা পার্বত্য নেতাদের।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের সংশোধিত আইনে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের নাম পরিবর্তন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ করা হয়। এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৯ সালে একটি আইন করে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) গঠিত হয়। একই বছরের ২৫ জুন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারম্যানসহ ৩১ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ গঠিত হয়। এরপর জেলা পরিষদে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। মাঝখানে পার হয়ে গেছে শান্তিচুক্তির তিন দশক।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন সংগঠন ও দলের নেতাদের সঙ্গে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়ে কথা বলে জানা গেছে, জেলা পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগে জনবল নিয়োগ দেওয়া হলেও দলীয় লোকজনই প্রাধান্য পাচ্ছে। উন্নয়নমূলক বিভিন্ন টেন্ডারের কাজও পাচ্ছেন দলীয় লোকেরা। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠান তিনটি দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

পিসিজেএসএসের কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, পার্বত্য তিন জেলা পরিষদে টাকা ছাড়া চাকরি মেলে না। সাধারণ মানুষ চাকরি পায় না।

পার্বত্য নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন বলেন, পার্বত্য তিন জেলা পরিষদে পাহাড়ি-বাঙালি বিভেদ বেড়েছে। জেলা পরিষদ থেকে বাঙালিরা কোনো সুযোগ পাচ্ছে না। পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন দিলে তাতে বাঙালিদের যুক্ত রেখে নির্বাচনে পার্বত্য মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। মনোনীতরা দলীয় নেতাদের কাছে জবাবদিহি করেন। জেলা পরিষদে নির্বাচন হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি সভাপতি মা ম্যা চিং বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধি হলেই যে জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটবে এমনটা নয়। আবার মনোনীত হলে জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটবে না তাও নয়। নির্বাচিত বা মনোনীত যাই হোক, তাদের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হবে।

সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে বর্তমানে হস্তান্তরিত বিভাগ ২৪টি, খাগড়াছড়িতে ২৩টি, বান্দরবানে ২৮টি। তবে মাধ্যমিক ও পর্যটনসহ কিছু বিভাগ পরিষদের কাছে হস্তান্তরের কথা বলা হলেও নিয়ন্ত্রণ পরিষদের হাতে নেই। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যানসহ পাহাড়ি-বাঙালি সদস্যসংখ্যা ১৫ জন। তার মধ্যে বাঙালি সদস্যসংখ্যা ৪, পাহাড়ি ১০। বান্দরবান জেলা পরিষদে চেয়ারম্যানসহ ১৫ জন। বাঙালি সদস্যসংখ্যা ৪, পাহাড়ি ১০। খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে চেয়ারম্যানসহ ১৪ জন। তার মধ্যে বাঙালি সদস্যসংখ্যা ৪, পাহাড়ি ৯। তবে চেয়ারম্যানের পদটি পাহাড়িদের জন্য নির্ধারিত করে দেওয়া আছে।

রাঙামাটি সার্কেলের রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় সম্প্রতি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন ও এর অধীনে নির্বাচন পরিচালনা না করার ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই মর্মে ধরে নিতে হবে। বাধা সৃষ্টি করছেন পার্বত্য মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বাঘাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বৃষ কেতু চাকমা বলেন, পরিষদের বিরুদ্ধে যে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা সত্য নয়। চাকরির নিয়োগ কমিটিতে জনসংহতি সমিতির একজন সদস্যকে রাখা হয়। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ সরকারের।

জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা বলেন, জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। সরকারের লোকজন সাংবিধানিক ও আইনি সমস্যার কথা তুলে ধরছেন। আসলে সাংবিধানিক কিংবা আইনি কোনো সমস্যা নেই। চুক্তি বাস্তবায়ন হলেই নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে সরকার।

গত ৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে  পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কমিটি পার্বত্য এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করে।

বৈঠকে জানানো হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন সহায়তার আওতায় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ২৪০ কোটি টাকার ৮৮২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলায় রাস্তা, সেতু, কালভার্ট, ফুট ব্রিজ, স্বাস্থ্য, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, বিভিন্ন অবকাঠামো, পর্যটনশিল্পের বিকাশ, বিভিন্ন ভবন নির্মাণসহ পূর্ত কাজ, কৃষি কার্যক্রম সম্প্রসারণ, জলবায়ু, পানীয় জলের ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, ছাত্রাবাস নির্মাণ, আবাসিক বিদ্যালয় পরিচালনা, মৎস্য চাষের ব্যবস্থা, সেচ ড্রেন, ফলদ বাগান সম্প্রসারণ, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

কমিটির সভাপতি দবিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অন্যদের মধ্যে কমিটির সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং, দীপংকর তালুকদার, এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ও বাসন্তী চাকমা বৈঠকে অংশ নেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের সদিচ্ছা হলেই তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন সম্ভব, অন্যথায় নয়। তবে এক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের ইতিবাচক মনোভাবও প্রয়োজন। তাদের মতে, সাবেক এই গেরিলা নেতার কূটচালেই বছরের পর বছর পাহাড়ের তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে না। সর্বোপরি পাহাড়বাসী মনে করেন, স্থানীয় জাতীয় নির্বাচনগুলো যে প্রক্রিয়ায় হয় সে প্রক্রিয়ায় তিন জেলা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হলে জনগণ তাদের আস্থার ঠিকানা খুঁজে পাবে। পাশাপাশি পরিষদগুলোর জনগণের নিকট জবাবদিহিতা বাড়বে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads