• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ধানে বিঘাপ্রতি লোকসান দুই হাজার টাকা

ফাইল ছবি

জাতীয়

ধানে বিঘাপ্রতি লোকসান দুই হাজার টাকা

  • মো. শাহাদৎ হোসেন শাহ
  • প্রকাশিত ১৫ মে ২০১৯

চলতি বছর ধানের জেলাখ্যাত দিনাজপুরে ইরি-বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলন ভালো হলেও ধানের দাম নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। হাসি নেই তাদের মুখে। কৃষকরা বলছেন, চাষে যত টাকা খরচ করা হয়েছে, ধান ঘরে তুললে সেই মূলধন ওঠা নিয়েই শঙ্কায় রয়েছেন তারা। মৌসুমের শুরুতেই বোরো ধান নিয়ে এমন বিপাকে পড়েছেন এ জেলার কৃষক। বাজারে ধান বিক্রি করে লাভ দূরের কথা, উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না তারা। ফলে বোরো ধান আবাদ করে এবার চরম হতাশ কৃষকরা।

বাজারে ধানের ন্যায্য দাম না থাকায় ইতোমধ্যে যারা ধান কেটেছেন, তারা ধান বিক্রি করে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। আর যারা এখনো ধান কাটেননি, তারা চড়া দামে মজুরি দিয়ে ধান কাটার সাহস করতে পারছেন না। কৃষকরা এখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। আয় ও ব্যয়ের মধ্যকার সঙ্গতি রাখতে পারছেন না তারা। যদিও চলতি বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের লক্ষ্যমাত্রার চাইতেও ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বেশি ইরি-বোরো ধান চাষ করা হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ১ লাখ ৭২ হাজার ১২৪ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়া ও কৃষি বিভাগের সঠিক তদারকি এবং দিকনির্দেশনার কারণে এবারে ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত ইরি-বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে। ফলে জেলায় এবারে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৩২৪ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। উৎপাদিত ধান থেকে এবার ৭ লাখ ৪০ হাজার টন চাল উৎপাদন হবে।

দিনাজপুরের অন্যতম বৃহৎ ধানের বাজার সদর উপজেলার গোপালগঞ্জ ধানের হাটে গিয়ে গত সোমবার দেখা যায়, বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। কৃষকরা জানান, এই দামে ধান বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও উঠবে না তাদের। বাজারে দাম না থাকায় বাধ্য হয়েই লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করছেন তারা।

গোপালগঞ্জ হাটে ধান বিক্রি করতে আসা সদর উপজেলার নশিপুর গ্রামের কৃষক হাফিজউদ্দীন জানান, প্রতি বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে ১৮ হাজার থেকে ১৯ হাজার টাকা। আর এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে ৩৪ মণ। এক বিঘা জমির ধান বাজারে বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ১৭ হাজার টাকা। এতে লাভ তো দূরের কথা, এক বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করে উৎপাদন খরচেই তার লোকসান গুনতে হচ্ছে ২ হাজার টাকা। তিনি জানান, ধার-দেনা করে বোরো ধান আবাদ করার পর তিনি এসব শোধ করবেন কীভাবে, আর খাবেনই বা কি? একই কথা জানান বাজারে ধান বিক্রি করতে আসা অন্য কৃষকরাও।

তাদের অনেকেই জানান, বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুম শুরু হওয়ায় শ্রমিক সঙ্কটের কারণে চড়া দাম দিয়ে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ করতে হচ্ছে। প্রতি বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করতে শ্রমিকদের দিতে হচ্ছে ৫ হাজার টাকা। এর ওপর বাজারে ধানের দাম না থাকায় ধান কাটতেও সাহস পাচ্ছেন না কৃষকরা।

সদর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের কৃষক সহিরউদ্দীন জানান, বর্গা নিয়ে ৪ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছেন তিনি। চাষ, সার, কীটনাশক, বীজ ও সেচসহ ৪ বিঘা জমিতে তার মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এখন প্রতি বিঘা জমির ধান কাটা ও মাড়াই করতে কৃষিশ্রমিকরা চাচ্ছেন ২০ হাজার টাকা এবং ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মজুরির টাকা বুঝে নেবেন। এ অবস্থায় বাজারে ধানের দাম না থাকায় বোরো কাটতে সাহস পাচ্ছেন না তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক তৌহিদুল ইকবাল জানান, জেলায় এবার মোট ১ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। ইোমধ্যেই বোরো ধান কাটা শুরু করেছেন কৃষকরা। তিনি জানান, দিনাজপুরে এখনো বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরু করেনি খাদ্য বিভাগ। তবে তা শুরু হলে বাজারে ধানের দাম বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সারা দেশে গত ২৫ এপ্রিল বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরু হলেও এখনো দিনাজপুরে তা শুরু হয়নি। এই সুযোগেই বাজারে ইচ্ছামতো দামে ধান কিনছেন মিলমালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আশ্রাফুজ্জামান জানান, দিনাজপুরে এবার ৮৫ হাজার ৪৭ টন সিদ্ধ চাল, ৮ হাজার ৭৮৪ টন আতপ চাল এবং ৫ হাজার ৪৮ টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২ হাজার ৪৭৯ জন মিলমালিকের সঙ্গে চুক্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। দিনাজপুরে মাত্র ৫ শতাংশ জমিতে বোরো ধান কাটায় এখনো বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরু করা হয়নি। তবে আগামী ৪-৫ দিনের মধ্যেই বোরো সংগ্রহ অভিযান শুরু করা হবে বলে জানান জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক।

এদিকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, বোরো সংগ্রহ ও ধান চাষে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির বিষয়টি নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আলাপ-আলোচনা করা হবে। তিনি জানান, কৃষি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বর্তমান সরকার কৃষকদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে আসছে। সার নিয়ে ও কৃষি উপকরণ নিয়ে কৃষকদের আর উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয় না। কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান, সে ব্যাপারে সরকার সজাগ রয়েছে বলে জানান তিনি।

জমি ভরা ধান, তবু ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকা : দিনাজপুরে ১৩ উপজেলার ধান চাষের হিসেব অনুযায়ী সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।

কৃষকরা জানান, ধানের উৎপাদন প্রতি মণে কৃষকদের খরচ হয়েছে ৭০০ থেকে ৭৪০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি বিঘায় উৎপাদন খরচ ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। অথচ বাজারে ধানের দাম মণপ্রতি ৫০০ থেকে থেকে ৬০০ টাকা। সে হিসাবে ধানের বর্তমান বাজার মূল্যে প্রতি বিঘায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা লোকসান পড়তে হচ্ছে। জেলার পুরো ১৩ উপজেলা মিলিয়ে এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।

চিরিরবন্দর উপজেলার অমরপুর ইউনিয়নের জয়দেবপুর গ্রামের কৃষক রেজাউল হক জানান, এক বিঘা জমিতে ৩০ মণ ধান হয়েছে, যার বাজার মূল্য ১৫ হাজার টাকা। অথচ চাষ করতে খরচ হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করতে চাই না, তাই জমিতেই ফেলে রাখছি।

তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন জমি ইজারা নিয়ে ধান চাষ করা কৃষকরা। খানসামা উপজেলার কৃষক ইমরান হোসেন জানান, তিনি এক বিঘা জমি শুধু ইরি মৌসুমের জন্য জমি মালিকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকায় চুক্তি নিয়ে ধান চাষ করেছেন। ওই জমিতে এবার ৪০ মণ ধান হয়েছে, যার বাজার মূল্য ২০ হাজার টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ ও চুক্তির টাকা সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে ২৬ হাজার টাকা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, বাজারে ধানের দাম নেই। তাই কিছু করা যাচ্ছে না। সরকার থেকেও এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads