• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও ঊর্ধ্বমূল্যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও ঊর্ধ্বমূল্যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ১৮ মে ২০১৯

রোজায় খাদ্যপণ্যে ভেজাল আর মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অভিযুক্তদের জরিমানা করেও ঠেকানো যাচ্ছে না অসাধুচক্রের অপতৎপরতা। রাজধানীর ফুটপাথ থেকে অভিজাত রেস্তোরাঁ এমনকি নামিদামি শপিং মলে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারী, নকলবাজ ও অতিমুনালোভী ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষ এদের কাছে পুরোপুরি জিম্মি। এ অবস্থাকে এক শ্রেণির মানুষের নীতি-নৈতিকতার পচন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিটি করপোরেশন বেঁধে দেওয়া মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে না কেউই। গরুর মাংস ৫২৫ টাকার স্থলে ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। কারো যেন কিছু বলা বা করার কিছু নেই।

মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে গরু আসছে না। হাটের ইজারাদাররা নির্ধারিত ইজারার চেয়ে ১০ গুণ বেশি টাকা আদায় করে গরুপ্রতি, চামড়ার দাম কম সব মিলিয়ে ৫২৫ টাকা কেজি গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা তো ৫০০ থেকে ৫২৫ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি করতে চাই। কিন্তু সেটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্ভব হচ্ছে না। নানা প্রতিকূলতার কারণে রাজধানীর শত শত গরুর মাংস ব্যবসায়ী দোকান গুটিয়ে নিয়েছে। কারণ ক্রেতা কম। ৬০০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস স্বল্পসংখ্যক মানুষ খেয়ে থাকে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে এখন আর কেউ গরুর মাংস কেনে না। সরকার আমাদের সঙ্গে বসুক। আলাপ-আলোচনা করে গরুর মাংস ব্যবসায়ীদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো পর্যায়ক্রমে সমাধান করুক তাহলে গরুর মাংস কেজিপ্রতি ৫০০ টাকায় বিক্রি করা যাবে। এতে বিক্রিও বাড়বে। ব্যবসায়ী ক্রেতা উভয়ের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে বলে আমি মনে করি।

এছাড়া নিত্য খাদ্যপণ্যের মধ্যে সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। মাছের দামও আকাশছোঁয়া এক কেজির একটি ইলিশের দাম ১২০০ টাকা, এক কেজি চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। বাইলা, বাইন, শিং মাছের কেজিও ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। দিন যত যাচ্ছে মাছ-মাংস সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মনিটরিংয়ে সিটি করপোরেশন দুটোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

এদিকে প্রতিদিন  ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভেজাল খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী, খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারী ও নকলবাজদের জেল-জরিমানা করলেও থেমে নেই অশুভচক্রের অপতৎপরতা। সম্প্রতি হাইকোর্ট বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড  টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় নিম্নমান প্রমাণিত হওয়ায় ৫২টি খাদ্যপণ্য অবিলম্বে বাজার  থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। নিম্নমান প্রমাণিত হওয়া পণ্যগুলো হলো সিটি অয়েলের সরিষার  তেল, গ্রিন বি চিংয়ের সরিষার  তেল, শবনমের সরিষার  তেল, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের সরিষার  তেল, কাশেম ফুডের চিপস, আরা ফুডের ড্রিংকিং ওয়াটার, আল সাফির ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজান ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্ণ ডিউয়ের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকান ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার, আরার ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, দীঘি ড্রিংকিং ওয়াটার, প্রাণের লাচ্ছা সেমাই, ডুডলি নুডলস, শান্ত ফুডের সফট ড্রিংক পাউডার, জাহাঙ্গীর ফুড সফট ড্রিংক পাউডার, ড্যানিশের হলুদগুঁড়া, প্রাণের হলুদগুঁড়া,  ফ্রেশের হলুদগুঁড়া, এসিআইর ধনিয়াগুঁড়া, প্রাণের কারি পাউডার, ড্যানিশের কারি পাউডার, বনলতার ঘি, পিওর হাটহাজারী মরিচগুঁড়া, মিষ্টিমেলা লাচ্ছা  সেমাই, মধুবনের লাচ্ছা  সেমাই, মিঠাইর লাচ্ছা  সেমাই, ওয়েল ফুডের লাচ্ছা  সেমাই, এসিআইর আয়োডিনযুক্ত লবণ,  মোল্লা সল্টের আয়োডিনযুক্ত লবণ, কিংয়ের ময়দা, রূপসার দই, মক্কার চানাচুর,  মেহেদীর বিস্কুট, বাঘাবাড়ীর  স্পেশাল ঘি, নিশিতা ফুডসের সুজি, মঞ্জিলের হলুদগুঁড়া, মধুমতির আয়োডিনযুক্ত লবণ, সান ফুডের হলুদগুঁড়া, গ্রিন  লেনের মধু, কিরণের লাচ্ছা সেমাই, ডলফিনের মরিচগুঁড়া, ডলফিনের হলুদগুঁড়া, সূর্যের মরিচগুঁড়া, জেদ্দার লাচ্ছা  সেমাই, অমৃতের লাচ্ছা সেমাই, দাদা সুপারের আয়োডিনযুক্ত লবণ, মদিনার আয়োডিনযুক্ত লবণ, নুরের আয়োডিনযুক্ত লবণ।

অভিযোগ রয়েছে, এসব খাদ্যপণ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে মার্কেট থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ থাকলেও অধিকাংশ কোম্পানি হাইকোর্টের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি। ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এসব ভেজাল পণ্য মার্কেটে এখনো রয়ে গেছে।

সম্প্রতি বিএসটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে  খোলাবাজার  থেকে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা কিনে বিএসটিআইয়ের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ৩১৩টি পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া  গেছে, এর মধ্যে ৫২টি পণ্য নিম্নমানের প্রমাণিত হয়েছে।

এ ব্যাপারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বাজার মনিটরিং করা হয় না এ কথাটি সঠিক নয়। কারণ সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে যাচ্ছে। তারা কোনো অনিয়ম পেলে, খাদ্যপণ্যে ভেজালের কোনো উপস্থিতি পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আদালত যে ৫২টি পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলো কোনো বাজারে বা সুপারশপে পাওয়া গেলে সুপারশপ ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উভয়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আসলে আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য আইন। আর মানুষ মানুষের জন্য। আমরা এসব ভুলে গেছি। আমরা নিজেদের দুই টাকা বাড়তি মুনাফার জন্য জাতির পাকা ধানে মই দিই। এ রকম ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। আসলে আইনের প্রয়োগ করে, জেল জরিমানা দিয়ে হাতেগোনা স্বল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, কিন্তু অপরাধ সর্বত্র যখন ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে তখন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়। প্রায় সবাই যখন লিপ্ত হয় ভেজাল কারবারে, অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তখন আর আইনের প্রয়োগ করে, জেল-জরিমানা দিয়ে খুব একটা কাজ হয় না। এ জন্য ওরিন্টেশন দরকার। নৈতিকতার পচন ধরা এসব মানুষগুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন করা দরকার, জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।

তিনি আরো বলেন, এ ব্যাপারে মহাপরিকল্পনা নিয়ে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তারপর সমাজে বিভিন্ন স্তরকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads