• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বাম্পার ফলনই কৃষকের হতাশা

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

বাম্পার ফলনই কৃষকের হতাশা

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২১ মে ২০১৯

চলতি বোরো মৌসুমে ধানের উচ্চ ফলনই কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক এবার বোরো চাষ করেছিলেন। ফলনও হয়েছিল বাম্পার। কিন্তু উৎপাদন খরচ, উচ্চ মজুরি তাদের জন্য কাল হয়ে উঠেছে। ফলে তারা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন।

জানা যায়, কৃষকরা যে পরিমাণ কায়িক শ্রম ও টাকা-পয়সা খরচ করে জমিতে ধান ফলান সেই অনুপাতে ধানের দাম পাচ্ছেন না। কৃষকদের অনেকেই ঋণ করে জমিতে ধান উৎপাদন করেছেন। এখন ফসল ওঠায় পাওনাদাররা তাদের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছেন। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।

সরকারের কৃষি বিভাগ দেশে এ বছর ১ কোটি ৯৬ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিল এবং বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী গত এপ্রিলের শেষ ভাগে ধান কাটা শুরু হওয়ার পর এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে কৃষকদের ধান কাটা এখনো অব্যাহত আছে। সরকার চলতি মৌসুমে প্রতি মণ বোরো ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ১০৪০ টাকা।

কিন্তু কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, ধানের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্য তো পাওয়া যাচ্ছেই না, এমনকি এর অর্ধেক দামেও তারা ধান বিক্রি করতে পারছেন না। তারা বলছেন, ধানের মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। কিন্তু বাজারে ধানের প্রকারভেদে এখন ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে না। সরকার এবারের ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে ১ লাখ ২৫ হাজার টন। বাজারে এবার ক্রেতাও কম বলে উল্লেখ করে কৃষকরা বলছেন, ধান ক্রয়ের ব্যাপারে সরকারও গড়িমসি করছে। এ পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ধানের ন্যায্য দাম না পেয়ে টাঙ্গাইলের এক কৃষক তার ধান ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। ধানের দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকরাও। ধানের মূল্য নিয়ে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতিকারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কৃষকরা ধানের যদি ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বারবার বঞ্চিত হতে থাকেন এবং লাভের বদলে দিনের শেষে তাদের লোকসান গুনতে হয় এর পরিণতি হবে অচিন্তনীয়। তারা সতর্ক করেছেন এই বলে যে কৃষকরা যদি ধান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে খাদ্যশস্যে দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার গর্ব নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে এ সমস্যা সমাধানে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

অন্যদিকে ২০১৭ সালে সিলেটে বন্যার কারণে চালের ঘাটতি দেখা দেওয়ায় চাল আমদানিকারকরা অতিরিক্ত চাল আমদানি করেন। ওই সময় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল আমদানি যথেষ্ট থাকলেও মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা ৩৯ লাখ টন চাল আমদানি করেন। ২০১৭ সালে আমদানি করা চাল এখন পর্যন্ত বিক্রি শেষ হয়নি।

এছাড়া গত মৌসুমে বোরো ও আউশের উৎপাদন ভালো হয়েছে। আমনের টার্গেট এক কোটি ৪০ লাখ টন থাকলেও উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখ টন অর্থাৎ ১৩ লাখ টন চাল অতিরিক্ত উৎপাদন হয়। আলু উৎপাদনের টার্গেট ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন থাকলেও উৎপাদন হয় এক কোটি তিন লাখ টন অর্থাৎ ৩৩ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়। এছাড়া বছরব্যাপী বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের কারণে গুদামে মজুদ থাকে। আগের ফসল মজুদ থাকায় ধানের দাম এবার কমে গেছে।

কৃষকদের দুরবস্থা থেকে উদ্ধারে সরকারেরও এ মুহূর্তে তেমন কিছু করার নেই বলে মন্তব্য করেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক। অস্বাভাবিকহারে ধানের দাম কমে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও খুবই চিন্তিত এবং সমস্যা সমাধানে সরকারের উচ্চ মহলে প্রচেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিদেশে ধান ও চাল রফতানির চিন্তাভাবনা চলছে। তবে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন আমদানিকারক দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি হঠাৎ করে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে তখন খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে, এ বিষয়টিও মাথায় রাখা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার চাইলেও কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে পারবে না। কারণ দেশে বার্ষিক ফসল উৎপাদন হয় সাড়ে তিন কোটি টন। সরকারিভাবে মাত্র ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। গত বছরের উৎপাদিত ফসলের প্রায় ১০ লাখ টন এখনো সরকারি গুদামে রয়ে গেছে। সুতরাং এ মুহূর্তে সরকারিভাবে ধান কিনলেও ১০ লাখ টন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

এছাড়া সঠিক কৃষক চিহ্নিত করাও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, তিনি ইতঃপূর্বে খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার উদ্যোগ নিয়েও সফল হননি। কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালীরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কৃষক সাজিয়ে ধান বিক্রি করেন। এ কারণে প্রকৃত কৃষকরা ন্যায্য দাম পান না। তিনি আরো বলেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে সরকারিভাবে সব ধরনের পণ্য কিনে মজুদের ব্যবস্থা থাকায় কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান। একসময় দেশে চালের চাহিদা সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে একই জমিতে বছরব্যাপী একাধিক ফসল উৎপাদন হওয়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদনের দেশে পরিণত হয়। কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান বা চাল কিনতে হলে সরকারিভাবে শতভাগ গুদামজাতকরণের সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

বাজারে ধান ও চালের দামের পার্থক্য, বঞ্চিত কৃষক : বাজারে কৃষক উৎপাদিত ধানের দাম আর ভোক্তা পর্যায়ে চালের দামে বিস্তর পার্থক্য। দুক্ষেত্রেই চালের দাম বিবেচনা করা হলে পার্থক্য কমপক্ষে ২২ থেকে ২৪ টাকা। এর সিংহভাগই চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। বাজারে চালের দাম অনুপাতে কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে দাম সমন্বয় জরুরি বলছেন বিশ্লেষকরা।

রাজধানীর কয়েকটি চালের বাজার ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের কাছে বেশি চাহিদা বিআর ২৮ চালের। খুচরা বাজারে এই চালের সর্বনিম্ন দাম ৪২ টাকা কেজি। আর ৫০ কেজি ওজনের এই চালের বস্তার মূল্য পড়ে দুই হাজার একশ টাকা। খুচরা বাজারের সঙ্গে পাইকারি বাজারের এই চালে দামের পার্থক্য ৫ থেকে ৬ টাকা।

পাইকাররা আড়তদার বা মিল মালিকদের কাছ থেকে এ চাল কেনেন ৩২ থেকে ৩৪ টাকা দরে। অর্থাৎ কৃষকের বিক্রি করা ধান চালে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় দামে পার্থক্য দাঁড়ায় ১৪ থেকে ১৬ টাকা।

খুচরা বিক্রেতা, পাইকার এবং মিল মালিকদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিআর ২৮ ধান কৃষক বিক্রি করছেন সাড়ে চারশ থেকে ৫শ টাকা মণ। অর্থাৎ কেজি প্রতি চালের দাম হিসেবে পাচ্ছেন ১৮ থেকে ২০ টাকা। এভাবে বাজার মূল্যের চেয়ে প্রতি কেজি চালে ২২ থেকে ২৪ টাকা কম পাচ্ছেন কৃষক। ধানের মানভেদে এই পার্থক্য আরো বেশি। বাজারে ধান ও চালের দামের এমন তারতম্যকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। সেটা হবে কি না, না জানলেও আগের মতোই আশায় বুক বেঁধে ধান ঘরে তুলছেন কৃষক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads