• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
টিকেট পেয়েই ঈদ আনন্দ

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

টিকেট পেয়েই ঈদ আনন্দ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০১৯

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শেষ। গতকাল রোববার শেষ দিনে দেওয়া হয় ৪ জুনের টিকেট। এদিনের টিকেট পেতে কেউ গত শনিবার মধ্যরাতে আবার কেউ গতকাল রোববার ভোরে এসে লাইনে দাঁড়ান। লাইনগুলো এঁকেবেঁকে অনেকটা নাগরিক কোলাহলে মিশে যায়। যদিও শেষ দিনে কাঙ্ক্ষিত টিকেট পেতে অন্যান্য দিনের তুলনায় টিকেটপ্রত্যাশীদের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। এর মধ্যে কাউন্টারগুলোর ধীরগতির কারণে টিকেটপ্রত্যাশী যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ ছিল না।

এসবের মধ্যেও প্রত্যাশিত টিকেট পেয়ে অনেকের মুখে ফুটে ওঠে রাজ্যজয়ের হাসি। এ যেন ঈদ আসার আগেই ঈদ আনন্দ। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ ভাগাভাগি করতে স্বস্তির ট্রেনের টিকেট পেয়ে অনেকেই বলেন, তাদের ঈদ শুরু হয়ে গেছে। অনেকের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো।

এদিকে যাত্রীসেবা বাড়ানো ও ভোগান্তি কমাতে এবার বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেনের মোট টিকেটের ৫০ শতাংশ ই-টিকেটিংয়ের জন্য রাখলেও রেলের ওয়েবসাইট ও নতুন তৈরি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে টিকেট কাটার চেষ্টা করতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হন অনেকে। সব মিলিয়ে ঈদযাত্রার নির্ভার অনুষঙ্গ ট্রেনের টিকেট কাটতে মানুষের আগ্রহ ব্যাপক বেড়েছে। অনেকে প্রত্যাশিত টিকেট পেতে রাজ্যের ভোগান্তি পোহান। সর্বশেষ টিকেট পেয়ে সব ক্লান্তি ভুলে যান।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাজ্জাদুল হক। বাড়ি রংপুরে। স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে তিনি ঈদে বাড়ি যাবেন। সেই লক্ষ্যে তিনি ৪ জুনের টিকেট কাটার জন্য শনিবার মধ্যরাতে কমলাপুর স্টেশনে এসে লাইনে দাঁড়ান। ক্রমশ লাইন এগুতে থাকে। অবশেষে দুপুর ১২টা ১৮ মিনিটে তিনি কাউন্টারে পৌঁছান। রংপুর এক্সপ্রেসের ৩টি শোভন চেয়ার টিকেট হাতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা সাজ্জাদ। এ যেন সোনার হরিণ পাওয়া। শুধু সাজ্জাদ নন, এমন শত শত টিকেটপ্রত্যাশী ২০-২২ ঘণ্টা কমলাপুর স্টেশনে রাত-দিন এক করে টিকেট সংগ্রহ করেন।

এবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে উত্তরবঙ্গ-পশ্চিমাঞ্চল ও খুলনা অঞ্চলে চলাচলকারী সুন্দরবন, চিত্রা, ধূমকেতু, বনলতা, সিল্কসিটি, পদ্মা, রংপুর, লালমনি, দ্রুতযান, নীলসাগর, একতা ও সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট দেওয়া হয়। এই ১২টি ট্রেনের মোট ১১ হাজার ৬৯টি টিকেট দেওয়ার কথা। এছাড়া চারটি স্পেশাল মিলে মোট ১৬টি ট্রেনের ১৪ হাজার ৭০০ টিকিট বিক্রি হওয়ার কথা।

কমলাপুরে নয়টি কাউন্টার থেকে টিকেট বিক্রি হয় এবার। অবশ্য প্রতিটি কাউন্টারে ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন টিকেটপ্রত্যাশীরা।

উত্তরবঙ্গগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেটের জন্য কাউন্টারের অপেক্ষা করছিলেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা রেজাউল আমিন। তিনি বলেন, মধ্যরাতে টিকেট কাউন্টের এসে দাঁড়িয়েছি। এখনো আমার সামনে অনেকেই। এদিকে কাউন্টারে ধীরগতি কাটছে না। ফলে আমরা খুবই বিরক্ত।

রাজশাহীগামী সিল্কসিটি ট্রেনের টিকেটের জন্য অপেক্ষা করছিলেন গণমাধ্যমকর্মী রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, শনিবার রাতে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু কাউন্টার থেকে জানানো হয় এসি টিকেট শেষ। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক বলেন, আগে ঈদের সময় এই কমলাপুরে ৩৩টি ট্রেনের টিকেট দেওয়া হতো। এখন দেওয়া হচ্ছে ১২টি ট্রেনের। এখন আগের তুলনায় ভিড় কমেছে।

রেলের অনলাইন টিকেট ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস লিমিটেড বাংলাদেশ (সিএনএসবিডি) সূত্রে জানা গেছে, এবার ৫০ ভাগ টিকেট অনলাইনে তিন পদ্ধতিতে দেওয়া হয়। প্রথমত মোবাইল এসএমএসে, দ্বিতীয়ত ওয়েবসাইট থেকে এবং তৃতীয়ত রেলের টিকেট কাটার সবশেষ ফিচার অ্যাপসের মাধ্যমে।

ঢাকা থেকে সবগুলো আন্তঃনগর ট্রেন মিলিয়ে দিনে প্রায় ৩০ হাজার ট্রেনের টিকেট রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ ভাগ রেলওয়ে কমকর্তা-কর্মচারী ও পাঁচ ভাগ ভিআইপি ছাড়া বাকি সব টিকেটের ৫০ শতাংশ অনলাইন ও এসএমএস ও অ্যাপে পাওয়ার কথা।

অনলাইনে ভোগান্তির শেষ নেই : ঈদের আগাম টিকেট বিক্রির চতুর্থ দিন রোববারও অনলাইনে ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে টিকেট কিনতে না পারার অভিযোগ করছেন অনেকে। বাধ্য হয়ে তাদেরকে ছুটতে হয়েছে কমলাপুর স্টেশনসহ বিভিন্ন গন্তব্যের জন্য নির্দিষ্ট কাউন্টারে। ফলে দ্বিগুণ ভোগান্তির শিকার হয়েছেন টিকেটপ্রত্যাশীরা। এদিন সকালে কমলাপুর স্টেশনে কথা হয় সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র হাসান ওয়ালীর সঙ্গে। রাজশাহী যাওয়ার সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট মোবাইল অ্যাপে কিনতে ব্যর্থ হয়ে কমলাপুর এসেছেন তিনি। তার ভাষ্য, অনেক চেষ্টা করেও মোবাইল অ্যাপে ঢুকতে পারেননি তিনি।

একই অভিযোগ করলেন মালিবাগের বাসিন্দা সোহাগ মোল্লা। খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সোহাগ মোল্লা বলেন, আমার বাসায় ব্রডব্যান্ড নেই। পাড়ার একটি কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে অনলাইনে টিকেট কেনার চেষ্টা করেছি। একইভাবে মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করেও টিকেট কেনার চেষ্টা করেছি; কিন্তু পারিনি।

রেলওয়ের অনলাইন টিকেট সেবা দিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিএন‌এসবিডি। ঢাকার স্টেশন থেকে অনলাইনে ৪ জুনের জন্য বরাদ্দ আছে ১০ হাজার ৫৬১টি টিকেট। এর মধ্যে দুপুর একটা ২০ মিনিট পর্যন্ত ছয় হাজার ৫৭৩টি টিকেট বিক্রি হয়েছে বলে তথ্য দেয় সিএন‌এসবিডি। তবে কমলাপুর স্টেশনের মনিটরে প্রদর্শিত সিএনএসবিডির এ তথ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কিনতে আসা রুহুল আমিন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র বলেন, ‘তারা দেখাচ্ছে কয়েক হাজার টিকেট বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এই টিকেট পেল কারা? আমি এখানে আসার পরও সকাল থেকে ৩৫-৪০ বার অ্যাপে টিকেট কেনার চেষ্টা করেছি, পারিনি। এখানে আমার আশপাশে যারা আছেন সবাই চেষ্টা করেছে অ্যাপসে টিকেট কেনার। আমার জানামতে কেউ পায়নি। অ্যাপে যদি এত টিকেট বিক্রি হতো তাহলে আমরা সবাই এখানে কেন?’

সিএন‌এসবিডির সিস্টেম এনালিস্ট ফারহান ইশতিয়াক বলেন, প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়া আর কারো বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি নেই। তিনি এই মুহূর্তে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।

ঈদের পর ই-টিকেটিংয়ের অব্যবস্থাপনার অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।

২২ ঘণ্টা দাঁড়িয়েও মেলেনি টিকেট : রাজধানীতে থাকা বাবা-মা, ভাই আর নিজের জন্য টিকেট কাটবেন মোহাম্মদ রমজান। জামালপুরে থাকা পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে যাবেন তারা। এজন্য ট্রেনের টিকেট কাটতে গতকাল দুপুর আড়াইটার দিকে তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে আসেন তিনি। একদিন আগে আসার পরও তার সিরিয়াল ৩৩ নম্বরে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত টিকেটের সন্ধান পাননি রমজান।

টিকেটপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল ৪ জুনের টিকেট কাটতে আসাদের অধিকাংশই গত শনিবার এসেছেন। কেউ কেউ সেহরির পর স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দেন।

শনিবার সকাল ৮টায় নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ এলাকা থেকে তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে আসেন জালাল। তিনি নিজের ও তার বাবা-মা আর স্ত্রীর জন্য ট্রেনের টিকেট কাটবেন। সিরিয়ালের ৮৮ নম্বরে থাকা জালাল বলেন, এখানে প্রচুর ভোগান্তি। ভোগান্তির শেষ নেই। গ্রামে ফ্যামিলি আছে। যাওয়া লাগবেই। রমজানের অভিযোগ, অনিয়ম হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। আমার সিরিয়াল ৮৮। সিরিয়াল এগোচ্ছে না।

এ সময় কারো মাথায় খবরের কাগজ, কারো মাথায় বাজারের ব্যাগ, কারো মাথায় পণ্যের মোড়ক, আবার কারো মাথায় ছাতা দেখা যায়।

টিকেট পাওয়ার আশায় অনেকে শনিবার রাত থেকে স্টেশনে অবস্থান করেন। তাদের একজন আশকারুল ইসলাম রিফাত। তিনি শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে এখানে অবস্থান করছেন। রোববার সকাল পৌনে ১০টার দিকে চারটি টিকেট হাতে পান তিনি।

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মোহাম্মদ মানিক কিছুক্ষণ পরপরই দেয়ালে হাত ঠুকছিলেন। জামালপুরের ইসলামপুরের দেওয়ানগঞ্জে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করবেন এই প্রত্যাশায় নারায়ণগঞ্জে থাকা স্ত্রী, শালিকা, ভায়রা আর নিজের জন্য টিকেট কাটতে এসেছেন তিনি।

তেজগাঁও স্টেশন মাস্টার এম এ আজিজ বলেন, ‘আমাদের এখান থেকে এ বছরই প্রথম ঈদে ট্রেনের টিকেট বিক্রি হয়। তাৎক্ষণিক তো সমস্যার সমাধান করা যায় না। আশা করছি, আগামী বছর এই সমস্যা থাকবে না।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads