• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
হালদায় ডিম কমেছে এক-তৃতীয়াংশ

ফাইল ছবি

জাতীয়

হালদায় ডিম কমেছে এক-তৃতীয়াংশ

  • চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • প্রকাশিত ২৯ মে ২০১৯

প্রত্যাশা বেশি থাকলেও ঘটেছে বিপরীত। এবার হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ কমে নেমে এসেছে এক-তৃতীয়াংশে।

গত শনিবার রাত সাড়ে ৯টার পর থেকে হালদার বিভিন্ন পয়েন্টে কার্প (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ) জাতীয় মা-মাছের ডিম ছাড়ার খবর আসতে থাকে। রাত ১২টার দিকে পূর্ণমাত্রায় ডিম ছাড়ে মা-মাছ।

হাটহাজারীর উত্তর মাদরাসার ডিম সংগ্রহকারী মোহাম্মদ জামশেদ বলেন, শুক্রবার রাতে ভারী বৃষ্টির পরপরই হালদা নদীতে অবস্থান নিই। শনিবার ভোর থেকে নদীর বিভিন্ন অংশে নমুনা ডিম সংগ্রহ করেছে জেলেরা। তবে দিন গড়িয়ে রাত এলেও ডিমের পরিমাণ বাড়ছিল না। ডিমের পরিমাণ এতই কম ছিল যে এগুলো নমুনা না চূড়ান্ত ডিম তা ঠিক করা যাচ্ছিল না। সব মিলিয়ে ১৫ কেজি ডিম সংগ্রহ করা গেছে।

সূত্র জানায়, হালদা থেকে ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে এক হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ কেজি (নমুনা ডিম), ২০১৫ সালে দুই হাজার আটশ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার পাঁচশ কেজি মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু এবার সে পরিমাণ নেমে এসেছে মাত্র সাত হাজারে।

হঠাৎ কেন হালদায় ডিমের পরিমাণ কমে গেল। অথচ এবার মা-মাছ শিকার বন্ধ ও ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ ধরে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ার মতো।

এর দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া। তিনি বলেন, হালদায় মা-মাছের ডিমের পরিমাণ কমার পেছনে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুটো কারণই দায়ী বলে মনে করি।

এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ রুইজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিগনি) প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। এ নদী থেকে সরাসরি রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে বিশেষ করে এপ্রিল, মে ও জুন এ তিন মাসে হালদায় পরিবেশগত কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য মা-মাছ ডিম ছাড়তে আসে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো ভৌতিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক। অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে বজ্রসহ প্রচুর বৃষ্টিপাত, উজানের পাহাড়ি ঢল, তীব্র স্রোত, ফেনিল ঘোলা পানিসহ নদীর ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বিত ক্রিয়ায় হালদা নদীতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে রুইজাতীয় মাছকে বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করে।

বিগত কয়েক বছরে অধিকাংশ সময় এপ্রিলের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে ডিম ছাড়লেও এ বছর মে মাসের শেষ পূর্ণিমার তিথি অতিক্রম করলে স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারীরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ে। এর অন্যতম কারণ অনুকূল পরিবেশের জন্য হালদা নদীর অববাহিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়া।

গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, এ বছর এপ্রিল-জুনে ছয়টি তিথির মধ্যে এপ্রিল-মেতে চারটি তিথি শেষ হয়েছে পর্যাপ্ত বৃষ্টি ছাড়া। সাধারণত এপ্রিল থেকে মাছের ডিম পরিপক্বতা লাভ করে। মার্চে কিছু অগ্রিম বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে অনেক হ্যাচারিতে রুইজাতীয় মাছের মধ্যে অগ্রিম পরিপক্বতা পরিলক্ষিত হয়। সে বিবেচনায় দীর্ঘ সময় পরিপক্ব গোনাড নিয়ে মা-মাছগুলো অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিল। এপ্রিল-মে মাসের অতিরিক্ত তাপমাত্রা এতে আরো প্রভাব ফেলে। এ অবস্থায় পূর্ণিমার তিথি না থাকা সত্ত্বেও ২৪ মে ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে ২৫ মে রাতে মা-মাছ ডিম ছেড়ে দেয়, যা সাধারণত অস্বাভাবিক।

দেশের দূষিত খালগুলোর মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে হালদা। ফটিকছড়ি, রাউজান ও হাটহাজারীর বিস্তীর্ণ এলাকার প্রায় সব বর্জ্যই আসে হালদায়। সম্প্রতি সে বর্জ্যে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে প্লাস্টিকের বোতল ও প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য।

এবার হালদার প্রজনন এলাকায় প্লাস্টিক বোতলসহ প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের ময়লা আবর্জনা ভাসতে দেখা যায় যা বিগত বছরগুলোতে পরিলক্ষিত হয়নি। এ কারণে পানির পিএইচএর মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি (৮+) বর্জ্য দূষণের ইঙ্গিত বহন করে।

সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মার্চের শেষ বা এপ্রিলের প্রথম দিকে কালবৈশাখীসহ প্রথম ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর অববাহিকার শীতকালীন সময়ের দূষিত পদার্থ এবং ময়লা আবর্জনা পানির স্রোতে ধুয়ে যায়। অমাবস্যা বা পূর্ণিমার সময় দ্বিতীয় ভারী বৃষ্টিপাতের সময় মা-মাছ ডিম দেয়। এ বছর ২৪ মের আগে তেমন ভারী বৃষ্টিপাত না হাওয়ায় দূষিত পদার্থসমূহ ওয়াশআউট হওয়া সম্ভব হয়নি। যার ফলে ২৪ মে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে প্রচুর পরিমাণ দূষিত পদার্থ হালদার পানিতে মিশে অস্বাভাবিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কারণটি হলো উন্নয়ন প্রকল্পকেন্দ্রিক দুর্যোগ।

জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড হালদাসংলগ্ন তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি নদীর পাড় রক্ষা বাঁধ তৈরির দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ কারণে নদীতে সারা বছর ড্রেজার, ট্রলার প্রবেশ করেছে প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে। যা নদীর বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ, মাছ ও ডলফিনসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এতে অনেক মাছ মারাও গেছে।

উপজেলা প্রশাসনের হিসেবে, এ বছর আঘাতজনিত কারণে প্রায় ১৯টি ডলফিন এবং ৯টি মা-মাছের মৃত্যুর রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এর প্রভাবও ডিমের ওপরও পড়েছে। নদীতে মাছের আদর্শ আবাস ও প্রজননস্থল, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘কুম’। প্রজনন ক্ষেত্র এলাকার (কেরামতলি বাঁক থেকে রামদাশ মুন্সির হাট পর্যন্ত) ৯টি কুমের মধ্যে সাতটি নদীর বাঁকে ভাঙন প্রতিরোধক ব্লক বসানো, জিও বেগ ডাম্পিং করার ফলে মাছের আবাসস্থল ও প্রজনন ক্ষেত্রের পরিবেশের বিঘ্নতা সৃষ্টি হয়। এতে ডিম প্রাপ্তির পরিমাণকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া নদীর উজান এলাকায় তামাক চাষ বৃদ্ধি, ১৮টি শাখা খালে স্লুইস গেট নির্মাণ, মূল নদীতে রাবার ড্যাম তৈরি, শিল্প বর্জ্য, মা-মাছ নিধন, এশিয়ান পেপার মিল ও হাটহাজারীর খন্দকিয়া খালের ব্যাপক দূষণ মা-মাছের ডিমকে প্রভাবিত করেছে। তবে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন ডিমের পরিমাণ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, এবার প্রায় তিনশ নৌকায় করে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি নৌকায় কমপক্ষে তিন বালতি করে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। একেকটি বালতিতে যদি ১০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়, তাহলে ৯০০ বালতিতে কমপক্ষে ৯ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে। এবার ডিমের কোয়ালিটিও খুব ভালো

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads