• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বিষফোড়া হচ্ছে রোহিঙ্গারা

ফাইল ছবি

জাতীয়

বিষফোড়া হচ্ছে রোহিঙ্গারা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ জুন ২০১৯

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে গত তিন দশকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে আরো প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে ১০ লাখ রোহিঙ্গা মানবিক আশ্রয় পেয়ে তারা এখন ধীরে ধীরে বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠছে। ইয়াবা, মানব পাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আধিপত্য বিস্তারে তাদের মধ্যে বাড়ছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। চলছে অস্ত্রের মহড়াও। চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে খুন হয়েছেন ৩৮ রোহিঙ্গা। বাড়ছে অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধও। এছাড়া বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়া কিংবা ভিন্ন কোনো রাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টায় অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ প্রতিদিন ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

সম্প্রতি জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলে এক প্রতিবেদনে জানায়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বহুমাত্রিক ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই মানবিকতার কারণেই এখন নানা ঝুঁকিতে পড়েছে দেশটি। খুব সহসাই এ সংকটের সমাধান হবে না বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।

ডয়চে ভেলের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ। বাংলাদেশে এখন কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও। বন উজাড় হচ্ছে, পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে তারা। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সঙ্গে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও প্রকট হতে পারে, বাড়তে পারে নিরাপত্তা ঝুঁকিও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবেলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ। এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারকে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। না হলে দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে।

প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ঝুঁকির নানা দিক বিশ্লেষণ করা হয়। এর  মধ্যে আছে এইডস ও স্বাস্থ্যঝুঁকি, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক চাপ, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি, পর্যটনে ধস নামার আশঙ্কা, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং পাহাড়-বনের অপূরণীয় ক্ষতি।

ক্রমেই এসব ঝুঁকির বিষয় প্রকট হতে চলেছে। রোহিঙ্গারা দেশের সর্বত্র এমনকি বিদেশও যেতে চাইছে। ক্যাম্প ত্যাগ করে নানাভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বা জেলার চেকপোস্টগুলোতে আটক হয়ে গত দেড় বছরে প্রায় ৫৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত আনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন। তার মতে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আবাসন এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় তারা অনায়াসে ক্যাম্প থেকে যখন তখন বের হচ্ছে। এভাবে নানা উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। কোনোভাবে দেশের আনাচে-কানাচেতারা ভিত গাড়তে পারলে জড়াতে পারে নানা অপরাধেও।

তার আইডেনটিটি না থাকায় অপরাধ করে সহজে আত্মগোপনে যেতে পারার সম্ভাবনা শতভাগ। তাই দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্প এলাকায় কাঁটাতারের সীমানা বেষ্টনী তৈরির প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত তাদের সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে অভিমত পুলিশ কর্মকর্তা ইকবাল হোসাইনের। আবার স্থানীয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের ভাষ্য, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত ও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর বাধাগ্রস্ত করতে পরিকল্পিতভাবে শিবিরগুলোকে অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে।

কক্সবাজার সদর থানা পুলিশের একটি টিম গত শুক্রবার রাতে লিংকরোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-জ-৪৬৭৪) জব্দ করে। মাইক্রোবাসে ১৮ রোহিঙ্গা তরুণকে পাওয়া যায়। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে তৎপর আতাউল্লাহ গ্রুপের সদস্য।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প সূত্র জানায়, আটক রোহিঙ্গা তরুণের দলটির সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থায় ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। এরা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পে খুন, ছিনতাই, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ঘটিয়ে আসছে। তারা নিজেদের আরসা বা আল ইয়াকিনের সদস্য বলে পরিচয় দেয়। তারা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফের শিবিরে ঘাপটি মেরে প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল।

আটকরা কোথায় যাচ্ছিল, কীভাবে তারা গাড়ির ব্যবস্থা করল এবং ক্যাম্প এলাকা ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের একাধিক চেকপোস্ট কীভাবে পার হয়ে এলো, সেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

তাদের সঙ্গে মাইক্রোবাসের চালক উখিয়ার পূর্ব কুতুপালং পাড়ার সুমন বড়ুয়া ও হেলপার কক্সবাজার সাহিত্যিকা পল্লীর মো. আমিনকেও আটক করা হয়।

জেলা পুলিশের তথ্যমতে, টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের ডজনাধিক অপরাধী দল রয়েছে, যারা শিবিরের অভ্যন্তরে অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট ও মাদক বিক্রির আখড়া তৈরি, মানব পাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহসহ নানা অপরাধকর্ম করছে।

পুলিশসহ স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, টেকনাফ ও উখিয়ার শিবিরে সাতটি করে সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। এর মধ্যে টেকনাফের আবদুল হাকিম বাহিনী বেশি তৎপর। এই বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যখন-তখন লোকজনকে অপহরণ করে। মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করে লাশ গুম করে। ইয়াবা, মানব পাচারে যুক্ত থাকার পাশাপাশি এ বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের তুলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটায়। ২০১৬ সালের ১৩ মে টেকনাফের মুছনী রোহিঙ্গা শিবিরের পাশে শালবন আনসার ক্যাম্পে হামলা চালায় হাকিম বাহিনী। এ সময় আনসার কমান্ডার আলী হোসেন তাদের গুলিতে নিহত হন। তারা লুট করেছিল আনসারের ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৭ শতাধিক গুলিও। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের দক্ষিণ বড়ছড়ায় ছিল ডাকাত হাকিমের বাড়ি। ২০১৪ সালে রোহিঙ্গাদের পক্ষে ‘স্বাধিকার’ আন্দোলনের ডাক দিয়ে ‘আরাকান আল ইয়াকিন’ বাহিনী গঠন করে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন তিনি। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে ভিডিও বার্তায় রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করার ডাক দেন। হাকিমের পাঁচ ভাই জাফর আলম, রফিক, নুরুল আলম, আনোয়ার ও ফরিদের নেতৃত্বে অনেকে রোহিঙ্গা শিবিরের বিভিন্ন আস্তানা থেকে ইয়াবার টাকা, মুক্তিপণের টাকা, মানব পাচারের টাকা সংগ্রহ করে হাকিমের কাছে পৌঁছে দেন।

গত শুক্রবার ভোরে টেকনাফে তিন রোহিঙ্গা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। তারাও সম্প্রতি এক রোহিঙ্গা শিশুকে অপহরণ করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

প্রদীপ কুমার দাশের মতে, এরা শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ করে এমন নয়। সুযোগ পেলে স্থানীয় বাসাবাড়ি ও সড়কেও আক্রমণ চালায়।

পুলিশের তথ্যমতে, টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরে আরো একাধিক বাহিনী তৎপর রয়েছে। ছাদেক, হাসান, নুরুল আলম, হামিদ, নুর মোহাম্মদ ও গিয়াসের নেতৃত্বে ১০-২০ জনের সদস্য নিয়ে বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। তাদেরও ছয়জন খুন হয়েছেন। অন্য সদস্যরা আত্মগোপন করায় বাহিনীর তৎপরতা এখন শিবিরে নেই।

অপরদিকে উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়েরের মতে, উখিয়ার বিভিন্ন শিবিরেও রোহিঙ্গাদের একাধিক বাহিনী সংগঠিত হতে চেয়েছিল।

পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৭ জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন প্রায় ৩৮ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬, মার্চে ১০, এপ্রিলে ৪, মে মাসে ৫ জন ও ৭ জুন পর্যন্ত ৫ জন। টেকনাফ পুলিশের ভাষ্য, ৩৮ রোহিঙ্গার মধ্যে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ২১ জন। নিহতদের অধিকাংশ ইয়াবা কারবারি ও মানব পাচারকারী।

মাদকের পাশাপাশি নারীদের ওপরও নানা অত্যাচার করছে রোহিঙ্গা অপরাধীরা। গত ২৬ মার্চ বালুখালী শিবিরের ই-ব্লক থেকে পুলিশ আয়েশা বেগম (১৯) নামে এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে। ধর্ষণের পর তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয় বলে আলামত পাওয়া যায়। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মুখোশধারী একদল রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং শিবির থেকে খতিজা বেগম নামে এক কিশোরীকে অপহরণের পর ধর্ষণ ও হত্যা করে মরদেহ জঙ্গলে ফেলে যায়। সম্প্রতি বালুখালী শিবিরের এক ঘরে মুখোশধারী তিন যুবক ঢুকে এক কিশোরীকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানান, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে পুরনো-নতুন মিলিয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৯১৩ জন। তালিকাভুক্ত প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে জীবনধারণ পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের দেওয়া অনেক পণ্য তারা বাজারে বিক্রিও করে দিচ্ছে। এরপরও গোপনে বা কৌশলে ক্যাম্প ছাড়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে রোহিঙ্গারা।

অপরাধে জড়ানোর বিষয়ে প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, যেসব রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধ বেড়েছে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহলও বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পভিত্তিক মাদকের সঙ্গে বেশি জড়াচ্ছে। যে কোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে জানান তিনি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads