• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
নদীর নীরব কান্না শোনে না কেউ

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

নদীর নীরব কান্না শোনে না কেউ

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৯ জুলাই ২০১৯

দেশের আটটি প্রশাসনিক বিভাগের অন্যতম ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগে মোট নদীর সংখ্যা ১০২টি, যার প্রায় সবই দূষণ ও দখলের কবলে। তবু ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে এসব নদী।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন বলছে, বিভাগটির প্রায় সবকটি নদীতেই দখলদারের থাবা রয়েছে। প্রতিবেদনের আরেকটি তথ্য ভয়ংকর। ১০ জেলার বিভাগটির ১০২টি নদীতে ৮৪৪ বড় অবৈধ স্থাপনা রয়েছে, যার অধিকাংশই শিল্প-কারখানা। প্রতিবেদনের আরেকটি তথ্য মর্মস্পর্শী। বিভাগটির ১০২টি নদীর মধ্যে ১০০টির অবস্থা করুণ।

অথচ কথা ছিল অন্ন রকম। নদীর করুণ কান্না পরোক্ষভাবে আমাদের জন্যই কান্না বয়ে আনে। যুগ যুগ ধরে নদীকে কেন্দ্র করেই মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নদীর গুরুত্ব অনুধাবন করে পৃথিবীর চারটি দেশ ইকুয়েডর, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও কলম্বিয়া নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও নদীকে একই উপমা দিয়েছেন। তবু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। তাই হয়েছে ঢাকা বিভাগের নদীগুলোর ক্ষেত্রে। অন্তত নদীরক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন তাই বলছে।

প্রতিবেদনটি তৈরিতে ঢাকা বিভাগের ঢাকা ছাড়াও মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের নদীগুলো পর্যবেক্ষণ করে নদীরক্ষা কমিশন।

কমিশন বলছে, তারা দখলের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে। তাদের সুপারিশ মেনে অন্যরা কাজ করবেন। যদিও ১০২টি নদীর মধ্যে কিছু কিছু নদী একাধিক জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কোথাও একই নামে, কোথাও ভিন্ন নামে। ফলে একই নদীকে একাধিক নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

কমিশনের প্রতিবেদনে নদী দখলের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। কষ্টের কিংবা লজ্জার কথা, অনেক ক্ষেত্রে শিল্পমালিকরা শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন নদীর জমি দখল করে।

এর মাঝে কমিশন নিজেদের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে জানায়, তারা নিজেরা নদী রক্ষায় কিছুই করতে পারে না। শুধু সরকারের কাছে নিজেদের সুপারিশ জমা দিতে পারে। সরকারই জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তবে জেলা প্রশাসনের ১০টি কাজ থাকলে ১০ নম্বরেই রাখা হয় নদী দখল-দূষণ রোধকে। অবশ্য সম্প্রতি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া নির্দেশ দিলে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হন।

এর মাঝে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী রক্ষায় সরকারি কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা বা শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় অবাধে চলছে নদী দখল ও ভরাট। যার ফলে নদীগুলো এখন বিলীন হওয়ার পথে।

নদী কমিশনের দৃষ্টিতে নদী দখল-দূষণের জেলাওয়ারি চিত্র—

ঢাকা : এ জেলায় মোট নদীর সংখ্যা ৬টি। নদীগুলো হচ্ছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ইছামতি, ধলেশ্বরী ও বংশী নদী। সব নদীই দূষিত। ইছামতি নদীর তীরে ৭৫টি অবৈধ স্থাপনা আছে। ধলেশ্বরীতে ১০০ এবং বংশী নদীতে ৬০টি অবৈধ দখল স্থাপনা রয়েছে। অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ২টি বাজার এবং ৮৫টি শিল্প-কারখানা আছে। তুরাগ নদের তীরে ৩টি বাজার এবং ৮টি শিল্প-কারখানা, ইছামতি, ধলেশ্বরী ও বংশী নদীর তীরে ২টি করে বাজার রয়েছে।

মানিকগঞ্জ : এই জেলায় নদী আছে দুটি। ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গা। ধলেশ্বরীর তীরে দুটি শিল্প-কারখানা এবং কালিগঙ্গা নদীর তীরে ৩টি বাজার আছে।

মুন্সীগঞ্জ : মোট নদীর সংখ্যা সাতটি। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, রজতরেখা, বাংলাবাজার, চরবানিয়াল ও ইছামতি। এর মধ্যে পদ্মার তীরে ৩টি, মেঘনার তীরে ২টি, ধলেশ্বরীর তীরে ৪টি, রজনরেখার তীরে ২টি ও ইছামতির তীরে ৪টি বাজার আছে। অন্যদিকে ধলেশ্বরীর তীরে ২৪টি, মেঘনার তীরে ১২টি ও রজতরেখার তীরে ২টি শিল্প-কারখানা রয়েছে।

গাজীপুর : এই জেলায় রয়েছে তুরাগ, গোয়ালা, বংশাই, শালদহ, শীতলক্ষ্যা, পারুলিয়া, মাটিকাটা, সুতীয়া, ব্রহ্মপুত্র, বানার ও বালু নদী। এর মধ্যে তুরাগ তীরে ৩টি বাজার ও ২৫ শিল্প-কারখানা আছে। গোয়ালা নদীতে একটি, বংশাইয়ের তীরে একটি, শীতলক্ষ্যার তীরে একটি বাজার ও ৬টি শিল্প-কারখানা রয়েছে। এছাড়া পারুলিয়ায় ২টি, মাটিকাটার তীরে ১টি, সুতিয়ায় ২টি, ব্রহ্মপুত্রে ৫টি ও বানার নদীর তীরে ৪টি বাজার রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ : মোট নদী ৬টি। এগুলো হলো- বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও বালু নদী। এ নদীগুলোর তীরে ২৮টি বাজার এবং ১৮৮টি শিল্প-কারখানা রয়েছে।

কিশোরগঞ্জ : মোট নদী ৩৩টি। এর মধ্যে নরসুন্দা নদীর তীরে ১৪টি, ব্রহ্মপুত্রে ৭টি, সিংগুয়া ১টি, মেঘনায় ২টি, কালনী কুশিয়ারার তীরে ৭টি, বেতাগায় ৩টি, বেতাই ধমনীতে ৩টি, উজানধনুতে ১টি, ডুবিতে ৫টি, মগরা ১টি, ‍সুরমায় ১টি, কালনী ৩টি, ধনু ২টি, চিনাই ১টি, উজান ধনু ১টি, সুতী নদীর তীরে ৩টি ও আড়িয়ালখাঁ নদীর তীরে ছোট আকারের ১৫টি দোকান আছে।

মাদারীপুর : মোট নদী ৪টি। এর মধ্যে আড়িয়ালখাঁর তীরে ৫টি বাজার ও ২টি শিল্প-কারখানা, কুমার নদীর তীরে ৩টি বাজার ও ৪ শিল্প-কারখানা, লোয়ার নদীর তীরে ২টি বাজার ও ৩টি শিল্প-কারখানা এবং টরকী নদীর তীরে ২টি বাজার রয়েছে।

রাজবাড়ী : এই জেলায় নদীর সংখ্যা ১০টি। এর মধ্যে নদীর তীরগুলোয় ২টি বাজার, ৩টি হাট এবং ৩৫টি দোকান রয়েছে। এই নদীগুলোর তীরে শিল্প-কারখানা নেই। তবে বাজার আছে।

ফরিদপুর : জেলায় মোট নদীর সংখ্যা ১১টি। এর মধ্যে কুমার নদীর তীরে ২১টি বাজার, চান্দনা বারশিয়া নদীর তীরে ৬টি বাজার ও ২টি শিল্প-কারখানা, গড়াই নদীর তীরে ২টি শিল্প-কারখানা, মারকুমান নদীর তীরে ১০টি বাজার এবং পদ্মা নদীর তীরে ৮টি বাজার রয়েছে।

গোপালগঞ্জ : জেলায় মোট নদীর সংখ্যা ১২টি। এর মধ্যে ৯টিতে বাজার আছে। তবে কোনো শিল্প-কারখানা নেই।

নরসিংদী : জেলায় মোট ৭টি নদী রয়েছে। তবে এসব নদীর তীরে কোনো অবৈধ স্থাপনা নেই। যদিও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে এ জেলার পলাশ উপজেলায় বেসরকারি কোম্পানি প্রাণ কর্তৃক শীতলক্ষ্যা দখলের কথা।

নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারো আমরা আবার নতুন করে প্রতিবেদন তৈরি করছি। কাজ এখন চলমান রয়েছে। শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো নদী কী পরিমাণ দখলের শিকার, কী কী পদক্ষেপ নিয়ে নদী দখলমুক্ত করা যাবে এবং এ পর্যন্ত কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করা হবে।’ মুজিবর রহমান হাওলাদার আরো বলেন, ‘প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা জেলা নদী কমিশনের কমিটির সঙ্গে বসে তার এলাকায় কী কী নদী আছে, এসব নদীর পাশে কী কী ধরনের অবৈধ স্থাপনা আছে, আর এসব স্থাপনা উচ্ছেদে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেবেন। ইতোমধ্যে কিছু কিছু জেলা থেকে প্রতিবেদন আসতে শুরু করেছে।’ সব জেলার প্রতিবেদন পেলে কমিশনের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হবে বলেও তিনি জানান।

শুধু বুড়িগঙ্গা দখল ও দূষণের বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, বুড়িগঙ্গা রক্ষায় সরকার উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে এটা খুবই ইতিবাচক কিন্তু এই অভিযান পর্যাপ্ত নয়। উচ্ছেদকৃত জায়গা পুনরায় যাতে প্রভাবশালীরা দখল করতে না পারে সে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও করতে হবে। বর্তমানে নদীর যে সীমানা দেওয়া হচ্ছে তা নদীর অনেকটা ভেতরে দেওয়া হচ্ছে, তা আরো বাড়াতে হবে। নদীর পানিদূষণ রোধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীতে শিল্পবর্জ্য ফেলা রোধ করতে হবে।

অবশ্য সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদী দখলদারদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি  বুড়িগঙ্গাকে লন্ডনের টেমস নদীর আদলে গড়ে তোলা হবে বলে জানান। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রল হয় এবং হচ্ছে। একই অনুষ্ঠানে নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নদী দখলমুক্ত করা হবে। এ কাজে কেউ বাধা দিলে তার পরিণাম হবে ভয়াবহ।

নদী রক্ষার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, নদীগুলো হচ্ছে আমাদের দেহের শিরা-উপশিরার মতো। এগুলো শুঁকিয়ে গেলে আমরা যেমন স্বাস্থ্যবান হতে পারি না, রক্ত দূষিত হলে যেমন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হই, তেমনি নদীগুলো শুঁকিয়ে গেলে, দখল করলে ও নদীর পানি দূষিত হলে দেশ, মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপন্ন হয়। বিপন্ন হয় প্রাণিকুল। তাই আমাদের নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে।

নদী বিশেষজ্ঞ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, নদী রক্ষায় শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, নদী রক্ষায় নীতি ও আইন রয়েছে। এসব নীতি ও আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। নদীকে স্বাভাবিকভাবে চলতে দিতে হবে।

আরেক নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, নদীকে শুধু একটি শব্দ দিয়ে বিবেচনা করলে হবে না। তিনি বলেন, নদীর অববাহিকা, নদীর গতিবিধি, সেডিমেন্টের পরিমাণ, জোয়ার-ভাটার প্রভাব, নদীর দুই পাড়ের মাটির গুণাবলিৎ- এ সবকিছু বিবেচনা করেই আলাদা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে নদী রক্ষায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads