• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নবিদ্ধ করতেই ছেলেধরা গুজব

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নবিদ্ধ করতেই ছেলেধরা গুজব

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ২৩ জুলাই ২০১৯

পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে— এ গুজবে সারা দেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কাউকে সন্দেহ হলে গণপিটুনি দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। গত এক সপ্তাহে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন অন্তত ৫২ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের।

পুলিশ বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই একটি কুচক্রী মহল এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। তাদেরকে শনাক্ত করে গ্রেফতারের প্রস্তুতি চলছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। গুজব ছড়ানো একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

‘ছেলেধরা-গলাকাটা’ গুজবে গ্রাম অঞ্চলে মানুষ রাতে ঘর থেকে বের হচ্ছে না। অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় সন্তানদের স্কুলে পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে কেউ কেউ। তবে তারা কেউ কেউ ছেলেধরা কিংবা গলাকাটার ঘটনা দেখেছে, একে অন্যের কাছে শুনেছে বলে জানিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী, পাগল, ভবঘুরে এবং সহজ-সরল নারীরা। 

ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান মুঠোফোনে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, গুজব তো গুজবই। এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। তাই কুচক্রী মহল কোনো ইস্যু না পেয়ে আইনশৃঙ্খলাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। তাদেরকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। তিনি গুজবে কান না দিয়ে দেশের মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানান।

পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া ও পিআর শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক এআইজি মো. সোহেল রানা বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল এবং গণপিটুনি দিয়ে মৃত্যু ঘটানো ফৌজদারি অপরাধ। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যার প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, গুজব ছড়ানো এবং গুজবে কান দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে গণপিটুনি না দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিন।

জানা গেছে, গতকাল রোববার সকালে ছেলেধরা সন্দেহে নওগাঁর মান্দা উপজেলায় ছয় জেলেকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার কুসম্বা ইউনিয়নের বুড়িদহ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। শনিবার রাজশাহীর তানোরে ছেলেধরা সন্দেহে পৃথক স্থানে দুই যুবককে গণপিটুনি দিয়েছে এলাকাবাসী। ওইদিন বিকেলে উপজেলার কলমা ইউনিয়নের বহাড়া ও কামারগাঁ ইউনিয়নের কচুয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গতকাল সকালে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। শনিবার রাতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় জনতা। রাত ৮টার দিকে গৌরীপুর ইউনিয়নের হিম্মতনগর বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

একই দিন রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে রাসেল মিয়া (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনির পর পুলিশে দিয়েছে এলাকাবাসী। আটক রাসেলের দাবি, তিনি ফুল ব্যবসায়ী। রাত সাড়ে ৯টায় ফতুল্লার শিহারচর লালখাঁ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দুজনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এতে একজন যুবক নিহত ও আরেক নারী আহত হন। তবে তাদের গণপিটুনির পরও তারা ছেলেধরা কি-না সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

একই দিন ভোরে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করতে গিয়ে অভিভাবকদের গণপিটুনির শিকার হন রেনু নামে এক নারী। তার চার বছর বয়সী মেয়েকে স্কুলে দিতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে। সন্দেহজনক আচরণের কারণে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। একই দিন সাভারের ফল ব্যবসায়ী রাসেল মিয়াকে, পাবনায় এক যুবককে, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এদিন সাভারের তেঁতুলঝোড়া এলাকায় এক শিশুকে বিস্কুট খাওয়ানোর সময় এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় অপরিচিত হওয়ায় তিন ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে আহত ও ১১ জুলাই চাঁদপুরে মনু মিয়া (৪০) নামের একজনকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়। পরে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে মনু মিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি। চালচলনে সন্দেহ হওয়ায় তাকে গণপিটুনি দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছেলেধরা গুজবে সবচেয়ে বেশি বিপদের মধ্যে রয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধী, পাগল, ভবঘুরে এবং নারীরা। মানসিক প্রতিবন্ধী দেখলেই ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় ছিন্নমূল, বাস্তুহারা, পাগল প্রকৃতির মানুষ দেখলেই তাদের ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপক মারপিট শুরু করছে স্থানীয় লোকজন। মানসিক প্রতিবন্ধী ও নারীরা আতঙ্কে নিজের পরিচয় সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছে না। ফলে মানসিক প্রতিবন্ধীরা ছেলেধরা সন্দেহে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনিতে হত্যা ও মারধরের শিকার হচ্ছে। বিভ্রান্তিতে পড়ে অতি উৎসাহী এক ধরনের মানুষ এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, যে কোনো উন্নয়নকে কেন্দ্র করে মানুষের রক্ত লাগে, শিশুদের মাথা লাগে- এ ভ্রান্ত ধারণা মানুষের মনে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এগুলো যখন গুজব আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন যে কাউকে দেখলেই সন্দেহ করে সাধারণ মানুষ, তাদের সঙ্গে হিংস্র আচরণ করে। মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বিশ্বাস না থাকাও গণপিটুনির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার একটি অন্যতম কারণ।

এ পরিস্থিতি উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের সবসময় সতর্ক আচরণ করতে হবে, এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তৎপর থাকতে হবে। এছাড়া এলাকার নির্বাচিত ও অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে একটি কমিটি হতে পারে। এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে তাকে ধরে কমিটির কাছে এনে যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে। এছাড়া স্কুল ও মসজিদভিত্তিক শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। শিশুদের জানাতে হবে যাতে তারা অভিভাবককে না বলে কারো সঙ্গে কোথাও না যায়। টিভিতে, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ ও সমাবেশের মতো সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads