• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
ফায়দা লুটছে বেসরকারি হাসপাতাল

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

ফায়দা লুটছে বেসরকারি হাসপাতাল

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ২৯ জুলাই ২০১৯

ভয়াবহ আকার নিয়েছে ডেঙ্গু রোগ। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এত দিন ঢাকায় সীমিত থাকলেও এখন ছড়িয়ে পড়ছে বাইরে। এই ভয়াবহতার সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। মুনাফাখেকো মনোভাব থেকে গলা কাটছে সাধারণ মানুষের। ফলে যাদের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে তাদের কষ্ট আর ভোগান্তির যেন শেষ নেই।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের স্বজন, সরকারের বিভিন্ন সূত্র ও বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনায় সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে সুযোগ না পেয়ে অনেক স্বজন রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।   

এ কে এম ফারুক আলম একজন সরকারি চাকরিজীবী। তার এগারো বছরের ছেলে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে নিয়ে যান ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালে। পাঁচ দিন ভর্তি রাখতে হয় সেখানে। এতে তার ব্যয় হয় ৩৫ হাজার টাকা। গত শুক্রবার ছেলেকে বাসায় নিয়ে গেছেন ফারুক আলম। এর সঙ্গে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় হিসাব করলে টাকার অঙ্ক আরো বেড়ে যাবে।       

তিনি বলেন, খুবই ভয়ে ছিলাম কয়েকটি দিন। ছেলে আমার এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। টাকা খরচ হয়েছে অনেক। রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় রক্ত দিতে হয়েছে। তার ওপর প্রতিদিন নানা রকম পরীক্ষা চলছে। একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, যার দাম সাড়ে ৬ হাজার টাকা।

বেসরকারি মেডিকেল, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করার জন্য পরীক্ষার ফি নির্ধারণ এবং তা সবার সাধ্যের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ নির্দেশের কয়েক দিন চলে যাওয়ার পর গতকাল বেসরকারি হাসপাতালগুলোর পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে পরীক্ষাসংক্রান্ত ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও অন্যান্য ব্যয় নিয়ে কোনো বড় সিদ্ধান্ত হয়নি।

সরেজমিন কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে মানুষের ভিড়ও বাড়ছে। হাসপাতালে পৌঁছে মানুষ প্রথমেই জানতে চান, ডেঙ্গু হয়েছে কি না। ঠিক এই সুযোগটাই কিছু বেসরকারি হাসপাতাল নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা পরীক্ষার ফি বেশি রাখছে। তাদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে গতকাল ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশ আদৌ কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসাব্যবস্থা তদারক করতে মাঠে নেমেছে দশটি বিশেষ টিম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা থেকে নিবন্ধিত রাজধানীতে বেসরকারি হাসপাতাল ১৯২টি। এর বাইরে পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট ক্লিনিক হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। তাদের অনেকের অনুমোদন নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার তথ্যমতে, রাজধানীতে নিবন্ধিত ১৯২টি বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়াও আবেদন করা হাসপাতালের সংখ্যা ৭০টি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আরো বেড়ে যাবে। ফলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় বলা যাচ্ছে না। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আক্রান্তের সংখ্যা ও প্রাণহানি থামানো যাবে না। 

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে ও মশানিধনে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। এখন রোগের প্রকোপ কমানো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। মৃত্যু কমানোর জন্য সঠিক চিকিৎসার ওপরই জোর দেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে চিকিৎসা সাধারণ মানুষ ও সীমিত আয়ের মানুষ যাতে স্বল্প খরচে চিকিৎসা নিতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি হাসপাতালে পেয়িং বেড ও কেবিন ছাড়া অন্য রোগীর ক্ষেত্রে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, পেয়িং বেড ও কেবিনের রোগীদের কাছ থেকে ২৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে এই পরীক্ষা হচ্ছে বিনামূল্যে। কিন্তু কেবিনের রোগীদের জন্য এই পরীক্ষা ৮৫০ টাকায় করা হচ্ছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, কিছু বেসরকারি হাসপাতাল এই পরীক্ষার জন্য বেশি টাকা নিচ্ছে। একটি বড় হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা আড়াই হাজার টাকা নিচ্ছেন। ধানমন্ডি-গ্রিন রোড এলাকার কিছু হাসপাতাল নিচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। ধানমন্ডির একটি হাসপাতাল কিছুদিন আগেও নিয়েছে ৭০০ টাকা। হঠাৎ তারা এ পরীক্ষার ফি দ্বিগুণ করেছে। পান্থপথের একটি হাসপাতাল নিচ্ছে ১ হাজার টাকা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান বলেন, মানুষের চরম বিপদের সুযোগ নিয়ে যারা ব্যবসা করে, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। তিনি বলেন, সরকার হূদরোগ চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, মানুষ উপকার পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও দাম নির্ধারণ করা দরকার।

হাইকোর্ট বলেছিলেন, বেসরকারি মেডিকেল, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার ফি যেন ব্যয়বহুল না হয়, জনগণ যাতে সাধ্যের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সেবা পান সে জন্য একটি ফি নির্ধারণ করে দিতে হবে।

চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানান রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ভর্তি রিয়ার বাবা ফরিদ সরকার। তিনি জানান, দৈনিক ৮-১০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে।

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সূত্র বলছে, একজন ডেঙ্গু রোগীর দৈনিক ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রতিদিন একটা ‘অ্যালবুটিক ইনজেকশন’ কিনতে হচ্ছে ৭ হাজার টাকা করে। জার্মান ও আমেরিকার তৈরি এই ইনজেকশন দেওয়া হয় শরীরের রক্তের প্রোটিন ‘অ্যালবুনিল’ বেশি কমে গেলে। এ ধরনের রোগীরা জটিল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এ ছাড়া প্রতিবার রক্তের ক্রসম্যাচিং করতে ব্যয় হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এর বাইরে দৈনিক বেড ভাড়া ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় তো রয়েছেই। এ ব্যয় সরকারি হাসপাতালের তুলনায় ৫-৮ গুণ বেশি। অর্থাৎ একজন ডেঙ্গু রোগীর সরকারি হাসপাতালে ব্যয় হচ্ছে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা। সরকারের নতুন পদক্ষেপে এই ব্যয় আরো কমে গেছে। সাধারণত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সচ্ছল রোগীরা ভর্তি হন। একদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা মান নিয়ে অসন্তুষ্ট, অন্যদিকে দ্রুত সুস্থ হতে চান তারা।

রাজধানীর এ্যাপোলো হসপিটালের মহাব্যবস্থাপক আলতাফ মাহমুদ খুরশিদ বলেন, আমাদের হসপিটালে চিকিৎসা ব্যয় আমাদের মান ও সেবার সঙ্গে সংগতি রেখে করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads