• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
‘পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে ষড়যন্ত্র বহু বছরের’

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

‘পার্বত্যাঞ্চল নিয়ে ষড়যন্ত্র বহু বছরের’

ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি

  • এ এইচ এম ফারুক
  • প্রকাশিত ২০ আগস্ট ২০১৯

পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের ভূখণ্ড দাবি করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাসরত চাকমা সম্প্রদায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে গত ১৭ আগস্ট মানববন্ধন করে। এর এক দিন পর রাঙামাটিতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে এক সেনাসদস্য নিহতের ঘটনায় পাহাড়বাসী মানুষের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক কর্মজীবনে দীর্ঘদিন পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি নিয়মিত পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বিষয়ে বিশ্লেষণ করে থাকেন। গতকাল সোমবার তিনি এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, গত শনিবার রাঙামাটিতে দায়িত্ব পালনকালে এক সেনাসদস্যের ওপর গুলিবর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভূখণ্ড দাবি করে ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবিকে হাস্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে অস্থিরতা এবং ষড়যন্ত্র বহু বছরের।

জেনারেল ইবরাহিম বলেন, নৃ-তাত্ত্বিক জাতিগতভাবে একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষ বিভিন্ন দেশের সীমান্তের এপারে-ওপারে থাকতে পারে। যেমন কুর্দি সম্প্রদায় তুরস্ক, ইরাক ও ইরান-তিন দেশের সীমান্তের সংযোগস্থলের চারদিকে আছে। একইভাবে বালুচি জনগোষ্ঠী আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান-এই তিন দেশের সীমান্তের সংযোগস্থলের চারদিকে আছে। তেমনি চাকমা সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করলেও তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশে এবং আরেকটি ক্ষুদ্র অংশ উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশে আছে।

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাসহ ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষই শান্তিতে বিশ্বাস করেন এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।  কিন্তু কিছুসংখ্যক দিগ্ভ্রান্ত উগ্রপন্থি তরুণ সন্ত্রাসে বিশ্বাস করে। তাদের দমন করতে স্থানীয় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই যথেষ্ট। পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে বর্তমান সরকারকে অধিকতর মনোযোগ দেওয়ার দাবি করেন তিনি।

এই বিশ্লেষক বলেন, সার্বিকভাবে পরিস্থিতিকে  ঘোলাটে করতে ত্রিপুরায় অবস্থিত চাকমা সম্প্রদায় একটি বিদ্ঘুটে দাবি উপস্থাপন করেছে।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের অংশ। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল। তারও আগে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের অধীন চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৮৬০ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার পার্বত্য এলাকাকে প্রশাসনিকভাবে আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৮৬০-এর আগে পরে ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল।

১৭৫৭ সালের আগে স্বাধীন বাংলার নবাব তথা মোগল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। সুতরাং ইতিহাস ও ভূগোলকে বিকৃত করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের চাকমা সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নিজ নিজ জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে থাকুন। আপনাদের কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের চাকমা সম্প্রদায় অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন। আরেক নিরাপত্তা বিশ্লষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির পরেও কিছু সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সক্রিয় আছে। তারা মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এমন গোলাগুলিতে লিপ্ত হয়। গত রোববার দুঃখজনকভাবে একজন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।

তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আনসেটেল বিষয়গুলো পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে সেটেল করা হয়েছে। শান্তিচুক্তিতে তাদের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা আছে। ঐতিহাসিকভাবে যা সেটেল তা আনসেটেল করার অবকাশ নেই। যারা সন্ত্রাস করছে, তারা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য করছে। এক প্রশ্নের জবাবে জেনারেল রশিদ বলেন, চাঁদাবাজির জন্য তারা এ আধিপত্য বিস্তারে লিপ্ত। ফলে সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের সময় পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে ইউপিডিএফ নামে আরেকটি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি করে। পরে পর্যায়ক্রমে জেএসএস ও ইউপিডিএফ ভেঙে চারটি সংগঠনে রূপ নিয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরও চাঁদাবাজির অভিন্ন উদ্দেশ্য লক্ষ করা গেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের ভূখণ্ড দাবি করার বিষয়ে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, কোনো দেশকেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দেওয়া অনুচিত। এমনিতেই বাংলাদেশ-ভারত পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো। সুতরাং সে ক্ষেত্রে ভারতও সেভাবে ভূমিকা রাখবে আশা করছি। তিনি বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম কখনো ভারতের অংশ বা অংশ হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএইচটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র থাকার কথা নয় আঞ্চলিক দলগুলোর। সশস্ত্র কর্মকাণ্ডও থাকার কথা নয়।

তিনি বলেন, কিন্তু চুক্তি সম্পাদনকারী সন্তু লারমা স্বয়ং বলেছেন, সব অস্ত্র জমা দেননি, বরং তারা স্বল্পমাত্রায় আবারো অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। সুতরাং পাহাড়ে সেনাসদস্যসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের দায় সন্তু লারমাকে নিতে হবে। চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে এর জবাবদিহিতা চাইতে হবে। আইনানুগ ব্যবস্থাও নিতে হবে। এই বিশ্লেষক বলেন, যেহেতু আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কছে অবৈধ অস্ত্র বিদ্যমান এবং তারা সশস্ত্র কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, সে কারণে পাহাড়ের নিরাপত্তাব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাহারকৃত নিপারত্তা বাহিনীর ক্যাম্পগুলো স্থাপন করাও জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজাতেও সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের ভূখণ্ড দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, দুই দেশের সরকারের বোঝাপড়া ও সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। উত্তর-পূর্ব ভারতের তথা সেভেন সিস্টারসের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ যেভাবে সহযোগিতা করেছে, তেমনি ভারতও তার ভূখণ্ডে বাংলাদেশবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড চালাতে দেবে না-এমনটাই প্রত্যাশা করি। সরকারকে সংবিধান অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবার পরামর্শও দিয়েছেন এই গবেষক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads