• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

চার মাসে চাকরি হারিয়েছেন ১৬ হাজার ৮৪৯ শ্রমিক

বন্ধ হয়েছে ৩৫ পোশাক কারখানা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

চার মাসে দেশের ৩৫টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে রয়েছে প্রতিবেশী প্রতিযোগী দেশের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়া এবং দেশের কারখানাগুলোর ক্রয় আদেশ কমে যাওয়া। এ ছাড়া কারখানা বন্ধ হওয়ার পেছনে নতুন কাঠামোতে বেতন পরিশোধে বেগ পাওয়া, শ্রমিক বিক্ষোভ ও শেয়ার্ড বিল্ডিং ব্যবহারের মতো কারণও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আগে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত কোম্পানি ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। ওই দুর্ঘটনার পর ১২শ থেকে ১৩শ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন হাজারের কিছু বেশি।

সূত্রটি জানায়, গত মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চার মাসে দেশে নতুন করে ৩৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ঈদুল ফিতর থেকে ঈদুল আজহার মধ্যবর্তী আড়াই মাসেই বন্ধ হয়েছে ১৫ থেকে ২০টি কারখানা। আর ৩৫টি কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে চাকরি হারিয়েছেন ১৬ হাজার ৮৪৯ জন শ্রমিক।

এর আগে, গত মে মাসের দিকে মাত্র ১৮ দিনে ২২টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে না পারা, শ্রমিক বিক্ষোভ ও শেয়ার্ড বিল্ডিং ব্যবহারের মতো নানা কারণে ওই কারখানা বন্ধ হয়। অভ্যন্তরীণ সমস্যাসহ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে তখন বন্ধ হওয়ার পথে ছিল আরো ৩০টি পোশাক কারখানা।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ের বন্ধ হয়ে যাওয়া তৈরি পোশাক কারখানাগুলো হলো-মালিবাগের লুমেন ড্রেস লিমিটেড (বেতন সমস্যা) ও লুফা ফ্যাশন লিমিটেড (বেতন সমস্যা); বাড্ডার সুমন ফ্যাশন গার্মেন্টস লি. (শ্রমিক বিক্ষোভ); শান্তিনগরের অ্যাপোচ গার্মেন্টস লিমিটেড (শেয়ার্ড বিল্ডিং); আশুলিয়ার মোভিভো অ্যাপারেলস লিমিটেড (শ্রমিক বিক্ষোভ) ও ফোর এস পার্ক স্টাইল লি. (বেতন সমস্যা ও শ্রমিক বিক্ষোভ); রামপুরার জেনস ফ্যাশন লিমিটেড (শেয়ার্ড বিল্ডিং); মধ্য বাড্ডার স্টার গার্মেন্টস প্রাইভেট লি. (বেতন সমস্যা ও শ্রমিক বিক্ষোভ); টঙ্গীর জারা ডেনিম লি. (শ্রমিক বিক্ষোভ), ফলটেক্স কম্পোজিট লি. (বেতন সমস্যা), এহসান সোয়েটার লি. (বেতন সমস্যা ও শ্রমিক বিক্ষোভ) ও মার্ক মুড লি. (বেতন সমস্যা); বনানীর তিতাস গার্মেন্টস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (শেয়ার্ড বিল্ডিং); গাজীপুরের ওসান ট্রাউজার লি. (বেতন সমস্যা ও শ্রমিক বিক্ষোভ) ও ওয়াসিফ নিটওয়্যার লি. (বেতন সমস্যা ও শ্রমিক বিক্ষোভ); জিরানীর ঝুমা ফ্যাশন লি. (বেতন সমস্যা ও শ্রমিক বিক্ষোভ); বোর্ড বাজারের স্পেস গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি লি. (বেতন সমস্যা) এবং উত্তর বাড্ডার এভার ফ্যাশন লি. (কারখানা বন্ধ)।

এছাড়া গাজীপুরের ইন্ট্রামেক্স অ্যাপারেল লি., ইন্ট্রামেক্স নিটওয়্যার লি., ইন্ট্রামেক্স সোয়েটার লি. ও ইন্ট্রামেক্স ক্লথিং কারখানায় বেতন সমস্যা ও শ্রমিক বিক্ষোভ চলে। তবে বন্ধ হওয়ার পথে থাকা ওই ৩০ কারখানা সম্পর্কে তথ্য জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ওইসব কারখানা থেকেই নতুন করে আরো ১৫ থেকে ২০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

সম্প্রতি রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থতি আলিফ অ্যাপারেল লিমিটেড নামক একটি কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। এটিসহ প্রতিষ্ঠানটি তাদের আরো দুটি কারখানা সরিয়ে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় নিয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের মদনপুরে নিজস্ব জায়গায় ২২ লাইনের ফ্যাক্টরি করা হয়েছে। সেখানেই এখন এই তিনটি কারখানার কার্যক্রম চলছে। এতে ঢাকায় সাময়িকভাবে বেকার হয়ে পড়েছে অন্তত দেড় হাজার শ্রমিক। বিনা নোটিশে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ায় ওই সময় শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। পরে শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে বলে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী শ্রমিক ও মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

আলিফ গার্মেন্টেসের একজন শ্রমিক আরিফ বলেন, ‘বর্তমানে ভাসমান অবস্থায় আছি। চাকরি খুঁজতেছি। এখনো কোথাও চাকরি হয়নি। একটি গার্মেন্টেসে কথা চলছে।’ এই শ্রমিক জানান, শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের বকেয়া পরিশোধ করা হয়েছে।

আগস্টের শেষ দিকে ব্যয় সঙ্কোচনের কারণ দেখিয়ে এসএফ ডেনিম অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের তেজগাঁওয়ের একটি কারখানাও ৭০০ শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করেছে। বিজিএমইএ বলছে, শ্রম আদেশ ৫০ শতাংশ কমে যাওয়ায় কারখানাটি এ পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, ইউনিয়ন করার জের ধরে ওইসব শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। কোম্পানিটির নামে একাধিক মামালাও রয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি টঙ্গীর বেইলি শিমা গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে বলেও শ্রমিক সংগঠন সূত্রে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ‘রমজানের আগে ২০ থেকে ২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পরে এখন পর্যন্ত আরো ১৫ থেকে ২০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর বর্তমানে কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে। আগে পুরো কারখানা বন্ধ করলেও এখন দেখা যাচ্ছে ১৫ লাইনের ফ্যাক্টরির ক্ষেত্রে দুই বা তিন লাইন বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে দুই থেকে তিনশ শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছে।’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘তিনটি কারখানার সঙ্গে এক সেপ্টেম্বর কথা হয়েছে। তারাও নানা সমস্যায় আছে। অনেক সময় তারা চুপিচুপি ছাঁটাই করছে। আমাদের ঠিকমতো জানাচ্ছেও না।’

বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে পোশাক খাতে ব্যবসার অবস্থা ভালো নেই। ক্রয় আদেশ (অর্ডার) কমে যাচ্ছে। কিছু নতুন প্রতিযোগী দেশও তৈরি হয়েছে। মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে অর্ডার বাড়ছে। এতে আমাদের দেশে অর্ডার কমে যাচ্ছে। এসব কারণেই অনেক কারখানা ব্যবসায় টিকে থাকতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা কারখানা বন্ধ করছে।’

বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে তারা অনেকেই কমপ্লায়েন্ট নয়। নতুন করে কমপ্লায়েন্ট করতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছে। আবার ক্রেতারাও অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে। আমাদের অনেক অর্ডার এখন পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। কারণ আমাদের এখানে ডলারের দাম ৮৪ টাকা, আর সেখানে তা ১৪০ রুপি। দরদাম হাঁকায় তারা এখন আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে চলে গেছে। এসবের সমন্বিত প্রভাবেই নতুন করে গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হচ্ছে।

এদিকে, বিজিএমইএ’র কোনো নেতা বা কর্মকর্তাই নতুন করে বন্ধ হয়ে যাওয়া ওইসব কারখানার নাম প্রকাশে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads