• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

মুখ থুবড়ে পড়ছে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রাজধানীসহ সারা দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে ২০১০ সালে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। গত ৯ বছরে এই প্রকল্প থেকে কতটা কাঙ্ক্ষিত ফল এসেছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জনবল সংকট ও অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে প্রকল্পটি মূলত মুখ থুবড়ে পড়ছে বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, রাজধানীকে ভিক্ষুকমুক্ত করার পাশাপাশি ভিক্ষাবৃত্তি থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। গত ৯ বছরেও এই প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। এর মধ্যে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়ে কিছু কিছু ভিক্ষুককে নিজ নিজ জেলায় বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পুনর্বাসিত করা হয়। তবে সেই পুনর্বাসন স্থায়ী হয়নি।

অনেক ভিক্ষুকই আবার ফিরে এসেছেন আগের পেশায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে মনিটরিং করতে না পারায় এই প্রকল্প থেকে সুফল মিলছে না। এই প্রকল্পের বরাদ্দও বছর বছর কমছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করলেও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভিক্ষাবৃত্তি দেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানই বলছে, সারা দেশে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ভিক্ষুক রয়েছেন। এদের অর্ধেকেরই বাস রাজধানীতে। তবে বেসরকারি হিসাবে সারা দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে এই জনগোষ্ঠীকে নিবৃত্ত করতেই ২০১০ সালের আগস্টে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক এই প্রকল্পে শুরুর দিকে ব্যাপক তোড়জোড় করে ভিক্ষুক ও ভবঘুরেদের জরিপ করা হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু চার বছরের মাথায় স্তিমিত হয়ে পড়ে সে কার্যক্রম। ওই প্রকল্পে প্রথম চার বছরে ২৪ কোটি ৮২ লাখ বরাদ্দ দেওয়া হলেও ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ কমেছে।

সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের আগস্টে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প চালু হলেও তা তেমন ব্যাপকতা পায়নি। পরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে প্রথমবারের মতো দেশের ৫৮ জেলায় এই প্রকল্পের আওতায় অর্থ পাঠানো হয়।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের জরিপ পরিচালনা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসাবে ২০১০-১১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা, এর মধ্যে ব্যয় হয় এক কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর পরের অর্থবছরে (২০১১-১২) প্রকল্পে ছয় কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও ব্যয় হয় মাত্র ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। এই টাকায় পাইলট আকারে ময়মনসিংহে ৩৭ জন ও জামালপুরে ২৯ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হয় এবং তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

পরে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই প্রকল্পে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও আনুষঙ্গিক খাতে খরচ হয় মাত্র তিন লাখ ৬২ হাজার টাকা। এর পরের অর্থবছরে বরাদ্দ কমে দাঁড়ায় এক কোটি টাকায়, তবে এ বছর কোনো অর্থছাড় করা হয়নি প্রকল্পে। অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রকল্পের আওতায় নামমাত্র কিছু কাজ হলেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই প্রকল্পের কোনো কাজই হয়নি।

এর পরের তিন অর্থবছরেই এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫০ লাখ টাকা করে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই প্রকল্পের আওতায় সাত লাখ ৯ হাজার টাকা ব্যয় করা হয় রাজধানীর রাস্তায় বসবাসরত শীতার্ত ব্যক্তিদের সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার কাজে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে স্থানীয়ভাবে ২৫১ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করার জন্য জেলা প্রশাসক ও অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকদের মাধ্যমে ব্যয় করা হয় ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯ জেলায় ৪১০ উপকারভোগীর জন্য খরচ করা হয় বরাদ্দের প্রায় পুরোটাই।

অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, পরের দুই অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন কোটি টাকা করে বরাদ্দ ছিল ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পে। দুই অর্থবছরেই বরাদ্দের পুরোটাই খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই হাজার ৭১০ জন ভিক্ষুকের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ পাঠানো হয় ৫৮ জেলায়। পরের অর্থবছরে একইসংখ্যক ভিক্ষুকের পুনর্বাসনের জন্য টাকা পাঠানো হয় ৩৮ জেলায়।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৮ জেলা থেকে জেলা প্রশাসক ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের যৌথ স্বাক্ষরিত চাহিদাপত্রে দুই লাখ তিন হাজার ৫২৮ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য ৪২২ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। এর বিপরীতে পরের অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া যায় মাত্র তিন কোটি টাকা।

জানা গেছে, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে যে স্বল্পসংখ্যক ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের আওতায় গ্রামে কিংবা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল, তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। পুনর্বাসিত ভিক্ষুকরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে ফের ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরেছেন। ভিক্ষুকদের ধরতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমও এখন আর দৃশ্যমান নয়। এক্ষেত্রে বরাদ্দ আর জনবলের অভাবকে দায়ী করছেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান।

 

কতটা ভিক্ষুকমুক্ত হয়েছে রাজধানী?

ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাজধানী ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করা। ঢাকায় ভিক্ষাবৃত্তি ঠেকাতে প্রাথমিকভাবে বিমানবন্দরে প্রবেশ পথের পূর্বদিকের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশের এলাকা, হোটেল র্যাডিসন সংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলি রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল সংলগ্ন এলাকা এবং কূটনৈতিক জোন এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে। এসব স্থানে ভিক্ষুকমুক্ত প্লাগস্ট্যান্ড লাগানো হয়, শুরুর দিকে লিফলেটও বিতরণ করা হয়, করা হয় মাইকিংও। ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণার পরও ভিক্ষুকমুক্ত হয়নি এসব এলাকা।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর সিগন্যাল, ফুটপাত, বাজার, রেল ও বাসস্টেশন, এমনকি ফুটওভার ব্রিজ থেকে শুরু করে আন্ডারপাসও চলে গেছে ভিক্ষুকদের দখলে। ভিক্ষুকদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যত্রতত্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। হয়রানিরও শিকার হতে হচ্ছে তাদের।

এ প্রসঙ্গে মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি ও ভিক্ষুকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এদের কারণে রাস্তাঘাটে চলাচলে অনেকেই অসুবিধার মুখে পড়ছেন। আইনপ্রয়োগ কিংবা সরকারের যে উদ্যোগ আছে তা বাস্তবায়ন না করতে পারলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও এর প্রভাব পড়বে।

 

সচল নেই আশ্রয়কেন্দ্রও

ভবঘুরে, ভিক্ষুক ও আশ্রয়হীনদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও এর মধ্যে পাঁচটি কোনো রকমে সচল রয়েছে বলে জানিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গত ৯ বছরে ৬ হাজার ১৪৭ জন ভবঘুরে ও ভিক্ষুক সরকারি সুবিধা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান।

সার্বিকভাবে ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ বিষয়কমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ দাবি করেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্পের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এই প্রকল্পকে আরো ব্যাপক পরিসরে নিয়ে যেতে চান তারা।

নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, সরকার হতদরিদ্রের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে চায়। বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। শিগগিরই তারাকান্দা এলাকায় একটি ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্র বড় আকারে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads