• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
আলোচিত সম্রাটকে আত্মসমর্পণে আল্টিমেটাম

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট

ফাইল ছবি

জাতীয়

আলোচিত সম্রাটকে আত্মসমর্পণে আল্টিমেটাম

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। গত রোববার নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে চিঠি দিয়েছে পুলিশ। এছাড়া তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থানায় আত্মসমর্পণের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। তবে সম্রাটসহ যুবলীগের প্রভাবশালী চার নেতা কোথায় আছেন- তা কেউ জানে না।

রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে অবৈধভাবে পরিচালিত ক্যাসিনোতে অভিযান চালানোর পর গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের নাম উঠে আসে। এরই মধ্যে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

সূত্র জানায়, যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তারের দিন থেকে সম্রাটকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি। তিনি এখন কোথায়-এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।

রাজধানীর কাকরাইল রাজমণি সিনেমা হলের উল্টোপাশে আটতলা ভবনে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ব্যক্তিগত অফিস। ভবনটির চতুর্থতলায় সম্রাটের অফিসের অবস্থান। এখানেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে বসেন। দিনের অধিকাংশ সময় এখানেই কাটাতেন তিনি। রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি-এসব এ ভবনে বসেই সম্রাট নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর সম্রাটের সহযোগী ও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে ক্যাসিনো পরিচালনাসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে যুবলীগের আরেক নেতা জিকে শামীমসহ আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপরই অবৈধ ক্যাসিনোর সঙ্গে যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ্যে এলে আত্মগোপনে চলে যান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল এবং ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতিঝিলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদ।

জানা গেছে, এই চার নেতাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কার্যালয়েও তারা যাচ্ছেন না, বাড়িতেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না বলে যুবলীগের কর্মীরা জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম অভিযানের দিন সম্রাট তার কাকরাইলের অফিসের অবস্থান করছিলেন। তবে বর্তমানে সম্রাট ওই অফিসে নেই, গা-ঢাকা দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। আবার কেউ বলছেন সম্রাট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন। তবে এ বিষয়ে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বা যুবলীগের কেউই কিছু বলছেন না।

তবে একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, সম্রাট এখন তার কাকরাইলে অফিসে নেই। তিনি অন্য কোথাও অবস্থান নিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সম্রাটের কাকরাইল অফিসের সামনেও আগের মতো কোনো ভিড় বা নেতাকর্মীর আনাগোনা লক্ষ করা যায়নি। স্বাভাবিক সময়ে সেখানে সব সময় ভিড় থাকে।

সূত্রগুলো আরো জানায়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পরও সম্রাট তার ব্যক্তিগত অফিসেই অবস্থান করেন। ওইদিন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হচ্ছেন সম্রাট। দুপুর থেকে সারা রাত যুবলীগের কয়েক শ নেতাকর্মী সেখানে অবস্থা নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে। এরপরও দুদিন অর্থাৎ শুক্রবার পর্যন্ত তিনি ওই অফিসেই ছিলেন। শনিবার সকালে বোরকা পড়ে তিন মহিলা ওই ভবনে ঢোকে। এরপর সম্রাট তাদের একজনের বোরকা পরে ভবন থেকে বের হয়ে যান। এর পর থেকেই তার অবস্থান সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন না।

সম্রাট দেশের বাইরে চলে গেছেন এমন গুঞ্জনও আছে। তবে অপর একটি সূত্র জানায় সম্রাট যেখানেই থাক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরদারিতেই আছেন। অভিযানের প্রথম দিন থেকেই সম্রাটকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী নজরদারিতে রেখেছে।

ওই সূত্রটি আরো জানায়, সম্রাটকে নজরদারির আওতায় রাখার জন্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গত রোববার পুলিশের পক্ষ থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

এদিকে যুবলীগের আরেক নেতা কাজী আনিসুর রহমানকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আনিস যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন এবং সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে পদ-বাণিজ্য করে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। শনিবার বিকাল থেকে খবর নেই কাজী আনিসেরও। দলীয় কার্যালয়ে তিনি যাচ্ছেন না, বাড়িতেও নেই তিনি। একইভাবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুলকেও। ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ ভূঁইয়ার সব ধরনের কাজ দেখভাল করতেন বকুল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের এক নেতা বলেন, ফকিরাপুলের ক্লাবের টাকা ওঠানো থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ খালেদের সব কাজের সঙ্গে বকুল জড়িত।

এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোমিনুল হক সাঈদও এখন পলাতক। বলা হচ্ছে, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোটি তার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। সাঈদের মোবাইল ফোনও বন্ধ।

যুবলীগের এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, সাঈদ সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন, শনিবার তার ফেরার কথা ছিল। কিন্তু অভিযানের কথা শুনে আর আসেননি।

যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণ মহানগরের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে স্বেচ্ছায় নিকটস্থ থানায় আত্মসমর্পণ করতে বলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যথায় তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান পরিচালনা করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সংস্থাগুলো বলছে, তাকে গ্রেপ্তার করার কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এরপরে যদি কোনো অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তবে, নেতাকর্মীরা যদি কোনো পরিস্থিতি তৈরি করে তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। সেটা সরকারের ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক হবে না। যুবলীগের এসব কর্মীরা যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, পুরো বিষয়টি তখন অন্যদিকে মোড় নিতে পারে।

সার্বিক বিবেচনায় সম্রাটকে গ্রেপ্তারের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এজন্যই তাকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে যদি সে আত্মসমর্পণ না করে তবে সম্রাটকে গ্রেপ্তারের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অভিযান পরিচালনা করবে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্রাটের অবস্থান, তিনি কার কার সঙ্গে কথা বলছেন, সবকিছুই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নখদর্পণে রয়েছে। কাজেই তার পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

নেপালি পালাতে সহায়তা করে পুলিশ নয় অন্য একটি সংস্থার সদস্য : মনিরুল

ডিএমপির মুখপাত্র ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ক্যাসিনো পরিচালনায় যুক্ত নেপালিরা আত্মগোপনে চলে গেছে। তাদের গা-ঢাকা দিতে পুলিশ সহায়তা করেনি। তাদের সহায়তা করেছে অন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোক। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ইতোমধ্যে তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

মনিরুল ইসলাম, অনেকেই না জেনে ওয়াকিটকি হাতে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিকে পুলিশ সদস্য বলে মন্তব্য করেছেন। শুধু পুলিশ সদস্যরাই ওয়াকিটকি ব্যবহার করে না। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত সদস্যরা, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও ওয়াকিটকি ব্যবহার করে থাকে। এ সময় তিনি নিশ্চিত না হয়ে পুলিশ সদস্য বলে প্রচার না করার অনুরোধ জানান।

আতঙ্কে ক্রেতাশূন্য রাজধানীর বৈধ বারগুলোতে

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাসিনো ও জুয়া খেলার বিরুদ্ধে অভিযানের রেশ পড়েছে বৈধ মদের বারগুলোতে। গত সোমবার ফু-ওয়াং ক্লাব, পিয়াসি ও গোল্ডেন ড্রাগন এবং শ্যালেতে অভিযানে কোনো ক্যাসিনো বা জুয়ার আলামত পায়নি পুলিশ। ওই বারগুলোর মদ বিক্রির অনুমোদন রয়েছে। একের পর এক অভিযানের কারণে নিয়মিত মদ্যপায়ীরাও আতঙ্কে আছেন। রাজধানীর বেশির ভাগ বারে এখন ক্রেতাশূন্য। তবে পারমিটধারী অল্প কিছু লোক যাচ্ছেন বারে।

পুলিশের পক্ষ থেকে অবৈধ বার ও জুয়ার আস্তানায় অভিযান পরিচালনার কথা বলা হলেও এখনো কোনো অবৈধ বারের বিরুদ্ধে অভিযান হয়নি। তবে জুয়ার আস্তানায় একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে।

সোমবার রাতে তেজগাঁও থানার পাশে ‘রেডবাটনে’ গিয়ে দেখা যায়, জনমানবশূন্য। ভেতরে একটি কক্ষে চারজন বসে আছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বারের এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশি অভিযানের কারণে ক্রেতাশূন্য হয়ে গেছে। অনেকেই আসছেন না পুলিশের ভয়ে। আবার কেউ আসছেন পারমিট নিয়ে।

জানা যায়, প্রতিদিন এই বারে অন্তত দুই শর বেশি লোক মদ পান করেন। প্রতিটি কক্ষই থাকে জমজমাট। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বার খোলা থাকে।

বারের ম্যানেজার কানাই লাল বণিক বলেন, এই বারে কোনো জুয়া বা ক্যাসিনোর ব্যবসা চলে না। অনুমোদন নিয়ে মদ বিক্রি হয়। পারমিটধারীরা এখানে মদ পানের জন্য আসেন। অনেক সময় তারা দু-একজন গেস্ট নিয়ে এসে মদ পান করেন। তবে পারমটি ছাড়া মদ সরবরাহ করা হয় না কাউকে।

তেজগাঁও থানার পাশে ‘সালামার’ বারের ম্যানেজার হারুন অর রশিদ বলেন, তাদের এখানেও কোনো জুয়া খেলার সুযোগ নেই। বৈধভাবেই তারা বার পরিচালনা করছেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, এই বারে পারমিট ছাড়া এবং কিশোর ও তরুণদের ভিড় লেগে থাকে।

এ প্রসঙ্গে হারুন বলেন, মাঝে মধ্যে পারমিটধারী কেউ কেউ তাদের গেস্ট নিয়ে আসেন। একজন নিয়মিত মদ্যপায়ীকে তার গেস্টের সামনে তুলে দেওয়া যায় না। তবে পারমিট নিয়ে মদ পানের জন্য নোটিশ টানানো রয়েছে বলেন তিনি।

একই কথা জানিয়েছেন ‘পিকক’ বারে ম্যানেজার হাবিব। তিনি বলেন, পিককে কোনো ক্যাসিনো নেই। জুয়া খেলারও কোনো ব্যবস্থা নেই। অনুমোদন নিয়ে তারা মদ বিক্রি করছেন। মাঝে মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালায়। তারা পারমিটধারীদের মদ বিক্রি করা হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করে চলে যান।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads