• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

আবরারের জন্য কাঁদছে দেশ

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় উত্তাল দেশ। অভিযুক্তদের বিচার দাবিতে সোচ্চার সর্বস্তরের মানুষ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক রাস্তায় নেমেছেন ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবিতে। কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্লগার থেকে শুরু করে মুক্তমনের সৃজনশীল সব মানুষের হূদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে এ নৃশংস হত্যায়। কেউ মেনে নিতে পারছেন না দেশের সর্বোচ্চ মেধার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন বিবেকহীনতা, রাজনীতির অপচর্চা এবং ভারতপ্রেমের চর্চা।

গত দুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ছিল আবরারময়। এমন হত্যা ও দেশপ্রেম বিরোধিতা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। দেশের গণমাধ্যমও গত দুদিনে আবরারের খবরে পূর্ণ ছিল।

ক্যাসিনোকাণ্ড, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও ইসমাইল হোসেন সম্রাট ছাপিয়ে এখন খবরের বড় অংশজুড়ে আবরার। এমনকি বিদেশি গণমাধ্যমেও আবরার হত্যার নানা খবর প্রকাশ হচ্ছে।

এমন ঘটনা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবায় সংশ্লিষ্টদের। অভিভাবকরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন। তাদের কণ্ঠে উঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্বৃত্তায়নও।

গল্পকার আনোয়ারা আল্পনা আবরারকে নিয়ে লেখেন, কখনো বাস চাপা দিয়ে মেরে ফেলবে, কখনো নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে। আমরা আবরারদের জন্য এই বাংলাদেশই গড়ে তুলেছি।

বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারোলাইনার অধ্যাপক জসিম ইমরান লেখেন, বুয়েটের শিক্ষক, হল প্রভোস্ট, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক, উপাচার্য- তারা কি এ ঘটনার দায় এড়াতে পারেন? হলের রুমে রান্না করার হিটার

 থাকলে তার খবর প্রভোস্টের কাছে চলে যায় কিন্তু টর্চার সেলের খবর তার কাছে থাকবে না- এটা কী করে হয়? আপনারা কি এই হাজার পাঁচেক ছেলেমেয়ের অভিভাবক নন?

সাংবাদিক ও কবি রায়হান উল্লাহ ফেসবুকে লেখেন, আমরা প্রকৃতই কতটা স্বাধীন এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে? স্বাধীনতার এতটা সময় পেরিয়ে। সঠিক অঙ্কটি ৪৮। মাত্র দু’বছর পর, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আর কতটা সময় লাগবে শির উন্নত করতে? নাকি বাঙালি আসলেই অসভ্য জাতি!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক ফেসবুকে লেখেন, ‘যেন শিবির হলেই কাউকে অকারণে মারা-ধরা যায়!’

বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী উল্লাস জায়েদ ফেসবুকে লেখেন, ‘সামান্য স্ট্যাটাসের জন্য আপনি মারা পড়তে পারেন, চাকরি হারাতে পারেন, হেনস্তা হতে পারেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান ফেসবুকে লেখেন, ‘ভাবতেই ভয় লাগছে, আমাদের অসহিষ্ণুতার পর্যায় কোথায় নেমে গেছে যে একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য মেরেই ফেলা হলো! যে ছেলেরা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে মেনে নিতে পারে না, সেই ছেলেরা দেশ পরিচালনা করবে কীভাবে? আমরা তবে কাদের পড়াই, কাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি, কাদের হাতে ভবিষ্যৎ?’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান ফেসবুকে লেখেন, ‘বুয়েট ছাত্র আবরারের অপরাধটা কী? আমি তো বলবো আরেকটা বিশ্বজিতের ঘটনা ঘটলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পিটিয়ে ছাত্রহত্যার অধিকার তো কেউ কাউকে দেয়নি। কারও অপরাধ থাকলে পুলিশ, প্রশাসন আছে কেন?’

কবি ও সাংবাদিক প্রতীক ইজাজ ফেসবুকে লেখেন, ‘ভাবা যায়, দুদফা ক্ষমতা কতটা বেপরোয়া করে তুলেছে সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের। তা না হলে বুয়েটের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ এভাবে একজন সহপাঠীকে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে! ক্ষমতা কতটা নৃশংস বর্বর করে তুলেছে ওদের! কতটা বিকৃত নষ্ট! ছি!’

কবি ও সাংবাদিক চঞ্চল আশরাফ ফেসবুকে লেখেন, ‘আবরারের ফেসবুক পোস্টগুলো পড়েছি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে তার বক্তব্য খুব যৌক্তিক, ইতিহাসবোধসম্পন্ন ও দেশপ্রেমপ্রসূত। তার সঙ্গে আমি একমত।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মীর্জা তাসলিমা সুলতানা লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টর্চার সেলের এবং ‘মজা করার’ নামে নানান কিসিমের টর্চারের অনুমোদন কি দিয়ে রাখিনি আমরা?’

বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ বলেন, আমরা অভিভাবক হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা-শিক্ষকরা বলি, প্রশাসন বলি, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।

মানবাধিকারকর্মী ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে গেছি, সারা বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে দাবি করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শান্তির জন্য সেদিনও একটা পুরস্কার পেলেন, তিনি মাদার অব হিউম্যানিটি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু আমরা কোন্ সমাজ, কোন্ রাষ্ট্রে বাস করছি?’

শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ফেসবুকে লেখেন, ‘আইন অবশ্যই তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বাংলাদেশে জজ মিয়া নাটকের যবনিকাপাত হয়েছে। তাই আস্থা রাখুন, অপরাধকারীরা ছাড় পাবে না।’

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আবরার যা কিছুই করুক না কেন, তাকে হত্যা করা অপরাধ। যারাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হোক না কেন, তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হবে।

গত রোববার রাতে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। আবরার তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। থাকতেন বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে।

এ হত্যার ঘটনায় গত সোমবার রাতে ১৯ জনকে আসামি করে তার বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন। এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মী। সর্বশেষ তাদের পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।

প্রসঙ্গত আবরারের ফেসবুক স্ট্যাটাস, যাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে, তাকে পিটিয়ে মারা হয়—

১. ’৪৭-এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

২. কাবেরী নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না, সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।

হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন- ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলি দাও/তার মতো সুখ কোথাও কি আছে/আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads