• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

২০০৫ ও ২০১১ নম্বর রুম ছিল ছাত্রলীগের টর্চার সেল

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১০ অক্টোবর ২০১৯

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে দুটি রুম ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহার করত ছাত্রলীগ। সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাতেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রুম দুটি থেকে মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবি শাখা নির্যাতনে ব্যবহূত লাঠি, স্ট্যাম্প, রড, চাকু ও দড়ি উদ্ধার করেছে। এছাড়া মাদক সেবনের আলামত পেয়েছে। তবে হল প্রশাসন এ বিষয়ে কিছুই জানত না বলে দাবি করেছে। শেরেবাংলা হলে দুটি ব্লক রয়েছে। একটি ‘শ-ব্লক’, অপরটি ‘হাজার-ব্লক’। দুই ব্লকেই রয়েছে ‘রাজনৈতিক কক্ষ’ বা ‘পলিটিক্যাল রুম’। তবে হাজার ব্লকে ‘২০০৫ ও ২০১১’ নম্বর রুম দুটি টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করত বলে জানিয়েছেন হলের শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, এক শ্রেণির ছাত্রলীগ নেতা ক্ষমতার দাপটে বুয়েটের আবাসিক হলগুলোকে অনেকটা ‘টর্চার সেলে’ পরিণত করেছেন। তুচ্ছ ঘটনায় যখন-তখন শিক্ষার্থীদের মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতারা। চুল বড় রাখা, ছাত্রনেতাদের সালাম না দেওয়া, এমন সব ঠুনকো অজুহাতে মারধর করে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলার সঙ্গে জড়িত বুয়েট ছাত্রলীগের হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির একাধিক নেতা। তাদের কথাই এখানকার অলিখিত আইন। পান থেকে চুন খসলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসত নির্মম নির্যাতন।

শেরেবাংলা হলের দুই তলার শেষ দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানের ২০১১ নাম্বার কক্ষটি ছিল ছাত্রলীগের তেমনই একটি টর্চার সেল। বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ মনে হলেও, শিক্ষার্থীদের কাছে কক্ষটি ‘টর্চার সেল’ এবং ‘পার্টি সেন্টার’ হিসেবেই পরিচিত।

শিক্ষার্থীরা জানায়, এই কক্ষে ডেকে নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প ও বাঁশ দিয়ে পেটায় ছাত্রলীগ সদস্যরা। কারণ ওই ঘটনার পর কক্ষটিতে প্রবেশ করে মদের খালি বোতল, ছুরি ও ক্রিকেট স্ট্যাম্প খুঁজে পাওয়া গেছে।

কক্ষটিতে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপদপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ সকাল এবং প্রত্যয় মুবিন নামে চারজন থাকেন। প্রত্যয়ের রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি।

অন্যদিকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে থাকতেন বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ও মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ইশতিয়াক হাসান মুন্না। এই কক্ষে তিনি একাই থাকতেন। কক্ষটি টর্চার সেল ছাড়াও পার্টি রুম হিসেবে পরিচিত। এই কক্ষের পাশের একটি কক্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, এই রুমে নিয়মিত ছাত্রলীগের নেতারা আড্ডা দেন। ছাত্রলীগের যেসব নেতা বুয়েট থেকে পাস করে গেছেন, তারাও এখানে এসে আড্ডা দেন।

শিক্ষার্থীরা আরো জানান, আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মিলনস্থল হিসেবে কক্ষটি ব্যবহার করা হতো। প্রায় প্রতি রাতেই সে কক্ষে পার্টি চলত। মাতাল শিক্ষার্থীদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেত। এতে আশপাশের কক্ষের শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা হলেও, ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না।

শিক্ষার্থীদের তথ্য অনুযায়ী, কক্ষটি ছাত্রলীগের ‘পলিটিক্যাল রুম’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থীদের ধরে সেখানে আনা হতো এবং নির্যাতন করা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ছাত্রলীগের এমন কক্ষ রয়েছে, যেগুলো ‘টর্চার সেল’ হিসেবে পরিচিত।

তবে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামিউস সানি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, বুয়েটে কোনো টর্চার সেল নেই। তবে শিক্ষার্থীদের থাকার কক্ষে ক্রিকেট স্ট্যাম্প, মদের বোতল এবং ছুরি থাকা উচিত নয়। কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিছু নেতার কথার অবাধ্য হলেই আবাসিক হলে ও ক্যাম্পাসে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে আহত ও রক্তাক্ত করার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে বুয়েটে। রক্তাক্ত অবস্থায় আবার পরীক্ষার আগে ক্যাম্পাস ছাড়া করার ঘটনাও ঘটেছে সংশ্লিষ্ট ছাত্রকে। হল পলিটিকসের দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রতিপক্ষ গ্রুপের এমনকি সাধারণ ছাত্রদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, নগদ অর্থসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে। আর সবই ঘটছে হল প্রশাসনের সামনে। অথচ অপকর্মে জড়িতদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো আহত, রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

হলে ছাত্র নির্যাতন ও টর্চার সেল থাকলেও সে বিষয়ে প্রভোস্ট ড. জাফর ইকবাল কিছুই জানতেন না। কোনো শিক্ষার্থী এসব বিষয়ে কখনো তাদের কাছে অভিযোগ করেনি বলে জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads