• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
‘মিয়ানমারের চেয়ে ভাসানচর ভালো’

ফাইল ছবি

জাতীয়

‘মিয়ানমারের চেয়ে ভাসানচর ভালো’

  • কক্সবাজার প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২০ অক্টোবর ২০১৯

স্বেচ্ছায় কিছু রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছেন। এরকম ১৭টি পরিবারের একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতে পৌঁছেছে। ফলে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

কক্সবাজারে আশ্রয় শিবিরগুলোতে গাদাগাদি করে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে সেখান থেকে এক লাখ শরণার্থীকে নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে উন্নত আবাসস্থলে স্থানান্তরের চেষ্টা করে আসছে। তবে রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছা ও কিছু এনজিওর বাধার কারণে তা সফল হচ্ছিল না। স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে চাওয়ার ঘটনা একদিকে যেমন সরকারের চেষ্টার সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে, তেমনি এ স্থানান্তর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। কারণ কিছু রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের পরিবর্তে ভাসানচরে যাওয়াই তারা ভালো মনে করছে। 

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের কিছু পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে। এরকম একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের হাতে পৌঁছেছে। তালিকায় ১৭টি পরিবারের নাম আছে। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক।  তাদের একটি করে ফরম দেওয়া হয়েছে। যার ওপরে লেখা ছিল ভাসানচরে স্থানান্তরে আগ্রহী বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের তালিকা। ফরমে ছয়টি তথ্যের ঘর রয়েছে।

ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে এমন পরিবারগুলোর একটি তালিকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, ভাসানচর যা রোহিঙ্গাদের কাছে ঠেঙ্গারচর নামে পরিচিত, সেখানে যেতে ওই রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির থেকে এখন বেশ সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে। এটি ভালো লক্ষণ। তবে যে তালিকা হাতে পেয়েছি সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়। বিষয়গুলো সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে এটা ভালো, তবে তাদের এই আগ্রহ কতদিন থাকে সেটাই দেখার বিষয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের তালিকা নেওয়া হচ্ছে। সেটি চলমান। বাংলাদেশের জন্য এটা অত্যন্ত ভালো দিক যে তারা স্বেচ্ছায় সেখানে যাওয়ার জন্য সম্মতি জানাচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত কতজন ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে, সে সম্পর্কে সুস্পস্ট করে কিছু জানাননি। 

টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া ও জাদিমুরা রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে, সেখানকার বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা বলেও এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। গত শুক্রবার এসব ক্যাম্পের মসজিদগুলোতে জুমার নামাজের পর ভাসানচরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার বিকালে টেকনাফের লেদা শিবিরের আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি, পুরনো-নতুন ১৫ জন রোহিঙ্গা নেতা, জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএমসহ কিছু এনজিও কর্মকর্তা ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে একটি বৈঠক করেন। সেখানে রোহিঙ্গা নেতাদের নিজ নিজ শিবির থেকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে বলা হয়। এসময় তাদের কিছু ফরম দেওয়া হয়। 

স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হওয়া নুর হোসেন (৫০) নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, ঠেঙ্গারচরে তৈরি করা ঘর-বাড়িগুলোর ভিডিও মোবাইল ফোনে আমাদের দেখিয়েছেন ক্যাম্প ইনচার্জ। এগুলো দেখে মনে হয়েছে সেখানে গিয়ে বসবাস করা আমাদের জন্য ভালো হবে। তাই পরিবারের চার সদস্যসহ আমি যেতে রাজি হয়ে তালিকায় নাম দিয়েছি। তবে সেখানে একবার ঘুরে এসে সেখানকার অবস্থা এখানকার রোহিঙ্গাদের বোঝানো গেলে আরো অনেকে ভাসানচরে যেতে রাজি হতো বলে তিনি মনে করেন।

রোকেয়া বেগম (৩৫) নামে এক বিধবা রোহিঙ্গা বলেন, আর মিয়ানমার ফিরে যেতে চাই না। তাই ঠেঙ্গারচরে যেতে রাজি হয়েছি। আমিসহ চার সন্তানের নাম দিয়েছি তালিকায়। আমার মতো আরো বেশকিছু পরিবার সেখানে যেতে ইচ্ছুক। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের খুব মানবিকভাবে দেখভাল করে যাচ্ছেন। ঠেঙ্গারচরে হয়তো ভালো জায়গাই হবে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রী সেখানে নিয়ে যেতে চাইতেন না আমাদের।’

লেদা শিবিরের নেতা মোস্তফা কামাল বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বৃহস্পতিবার এখানে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে এনজিও কর্মকর্তারাও ছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে, সরকার কাউকে জোর করে ঠেঙ্গারচরে পাঠাতে চায় না। তবে রোহিঙ্গাদের যাতে বোঝানো হয় সেটি বসবাসের জন্য ভালো জায়গা। ইতোমধ্যে দুটি ক্যাম্প থেকে কিছু রোহিঙ্গা পরিবার ভাসান চরে যেতে রাজি হয়েছে। আমার ক্যাম্প থেকেও রোহিঙ্গারা যাতে যেতে ইচ্ছুক হয়, সেভাবে কাজ করছি। 

টেকনাফ লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির প্রধান রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, এ শিবির থেকে বেশ কিছু পরিবার ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।  সেখানে উন্নত আবাসস্থল থাকার বিষয়টি রোহিঙ্গাদের ভালো করে বোঝানো গেলে সেখানে যেতে  ইচ্ছুকদের সংখ্যা বাড়বে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি ও টেকনাফ নিবন্ধিত নয়াপাড়া ও লেদা শিবিরের কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যেতে সরকার দীর্ঘদিন চেষ্টা করছিল। কেউ স্বেচ্ছায় রাজি না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে এগুনো যায়নি। যেহেতু এবার তারা নিজে থেকেই সেখানে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করছে, তাই বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে নিয়েছি।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, এখানে অবস্থানকারী বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা এই অঞ্চলের জন্য বড় রকমের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি এখান থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাও সরানো যায়, তাহলে কিছুটা হলেও চাপ কমবে। রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় সেখানে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠছে সেটা বেশ ভালো দিক।  

আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ভাসানচরকে স্থায়ী ঠিককানা হিসেবে দেখছে কিনা এবং তারা সেখানে গেলে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে- শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার বলেন, এরকম কোনো আশঙ্কা করছি না। কারণ রোহিঙ্গারা তো বোঝে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থাকা সম্ভব না। মিয়ানমারও তাদের জন্য এখন নিরাপদ হয়ে উঠছে। কক্সবাজার এলাকার চাপ কমানোর জন্য এবং রোহিঙ্গারা যাতে একটু ভালোভাবে থাকতে পারে সেজন্যই তাদের ভাসানচরে নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এটা স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়। এর জন্য প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে না।

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। সেসময় চরটিতে কোনো জনবসতি ছিল না। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে সহিংসতা বৃদ্ধির পর মিয়ানমার থেকে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে। এরপর কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য অবকাঠামো গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads