• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বিজয় দিবসে প্রকাশ হচ্ছে রাজাকারদের তালিকা

আড়াই হাজার ব্যক্তি চিহ্নিত

  • মো. রেজাউর রহিম
  • প্রকাশিত ০৮ ডিসেম্বর ২০১৯

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের যেসব বাঙালি খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও বেতনভুক হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, তাদের তালিকা বিজয় দিবস থেকে প্রকাশ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

গত ২৬ মে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশব্যাপী রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করে বলে জানানো হয়। সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয় জানায়, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটির সদস্যদের তালিকা সংগ্রহ করে তা রক্ষণাবেক্ষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আধা-সরকারি (ডিও) চিঠি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাজাকারের তালিকা হাতে আসা শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, এই ১৬ ডিসেম্বর থেকে যতটুকু আসবে পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি। এদিকে গত ২৫ আগস্ট সংসদীয় কমিটির বৈঠকে রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সম্প্রতি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের সব থানা থেকে স্বীকৃত রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় সে তালিকা জনগণের সামনে প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, সরকার নতুন করে রাজাকারদের তালিকা তৈরি করবে না। ১৯৭১ সালে যেসব রাজাকার পাকিস্তানি সরকারি ভাতা গ্রহণ করেছেন এবং যাদের নামে সে সময় অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, শুধু সেই সব স্বীকৃত রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে।

এ ব্যাপারে মক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এস এম আরিফুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ১০টি জেলা ও একটি উপজেলা থেকে আমাদের হাতে ২৭০ জনের মতো রাজাকারের তালিকা এসেছে। এ তালিকা সম্পূর্ণ তালিকা নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাচাই-বাছাইয়ের বিষয় আছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইতঃপূর্বে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আসা তালিকা এখনো আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রলালয়ে আসা রাজাকারদের তালিকা বিজয় দিবসে প্রকাশ করা হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তালিকা প্রণয়ন সংক্রান্ত একটি বৈঠক গত ১২ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে অনুষ্ঠিত হয়। সূত্র জানায়, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তৎকালীন ডিসিদের (২০ জেলা) কাছে পাকিস্তান সরকারের ভাতা গ্রহণকারী রাজাকারদের তালিকা ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সে সময় ক্ষমতাসীন সরকার এসব তথ্য-উপাত্তের একটি বড় অংশ সরিয়ে ফেলে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন করতে এর আগে ডিসিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে এক হাজারের বেশি নথি পাওয়া গেছে এবং প্রায় আড়াই হাজার ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা  গেছে। তবে এ সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত সংখ্যার চেয়ে বেশ কম উল্লেখ করে তিনি আরো জানান, এজন্য বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রচলিত ধারণামতে, অর্ধ লক্ষাধিক ব্যক্তি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এবং বাঙালিদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিকাণ্ড-অত্যাচারসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছিল।

এর আগে ২৬ মে জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজাকারের তালিকা তৈরির অগ্রগতির বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- একাত্তরে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠনে যেসব বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, তাদের তালিকা সংগ্রহ করে তা রক্ষণাবেক্ষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসকের রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) দেওয়ার কথা জানানো হয় তখন। সংসদীয় কমিটির কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, গত ২১ মে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে বেতনভোগী রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহর জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে চিঠি পাঠানো হয়। ২৮ মে তারিখে ওই তালিকা করার জন্য আবারো তাগিদ দেওয়া হয়।

এর আগে একাত্তরে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠনে যেসব বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, তাদের তালিকা তৈরির জন্য জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত সংস্থা। এ ছাড়া তালিকা সংগ্রহ করে তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও অনুরোধ জানায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামী ছিল অন্যতম। তখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করতে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আনসার বাহিনীকে এ বাহিনীতে একীভূতও করা হয়েছিল। প্রথমে এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত শান্তি কমিটির অধীনে থাকলেও পরে একে আধাসামরিক বাহিনীর স্বীকৃতি দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। একই রকম আধাসামরিক বাহিনী ছিল আল-বদর ও আল-শামস। তবে স্বাধীনতাবিরোধী এ বাহিনীগুলো সাধারণ অর্থে ‘রাজাকার বাহিনী’ হিসেবেই পরিচিত বাংলাদেশে। অন্যদিকে, প্রায় এক দশক আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর হওয়ার পর থেকেই দেশে রাজাকারের তালিকা তৈরির জোরালো দাবি ওঠে। ২০১২ সালে বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, রাজাকারের কোনো তালিকা সরকারের কাছে নেই। তবে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে খুলনায় আনসার হেডকোয়ার্টার্সে পাওয়া তালিকায় ৩০ হাজারের বেশি রাজাকারের তথ্য মিলেছিল। ওই তালিকাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রয়েছে। পাকিস্তান সরকারের বেতনভোগী ওই রাজাকারদের তালিকা যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হবে।

এদিকে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গত ২৬ মের বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অনুবিভাগে সংরক্ষিত রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলা প্রশাসকদের দপ্তর থেকে বেতন-ভাতা উত্তোলনকারীদের তালিকা সংরক্ষণের সুপারিশ করা হয়।  বৈঠকে জানানো হয়, তালিকা প্রস্তুত ও সংরক্ষণে আইন সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের আসনগুলো অবৈধভাবে শূন্য ঘোষণা করে তাদের স্থলে যাদের সদস্য বানোনো হয়েছিল তাদের নাম এবং স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতেও ওই কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।  শাজাহান খানের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, রাজি উদ্দিন আহমেদ, রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম ও এ বি তাজুল ইসলাম অংশ নেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads