• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

জামায়াত, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম নিষিদ্ধ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১১ ডিসেম্বর ২০১৯

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর যশোরে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা। দিনটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষ স্মরণীয়, গৌরব ও অহংকারের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবলমুক্ত বাংলাদেশের মাটিতে এ দিনে যশোর টাউন হল ময়দানে অনুষ্ঠিত মুক্ত বাংলার প্রথম এ জনসভায় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সমবেত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন।

জনসভায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আর ধ্বংস নয়, যুদ্ধ নয়। এ মুহূর্তে কাজ হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা।’ সেদিন তিনি সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জনসভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার, রওশন আলী, মোশাররফ হোসেন, তবিবর রহমান সরদার, সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান প্রমুখ।

মুক্ত স্বদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এ জনসভার খবর সংগ্রহের জন্য উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক পিটার গিল, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিডনি এসএইচ সানবার্গ, বালটিমোর সান পত্রিকার প্রতিনিধি এবং ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিনিধিসহ বিদেশি অনেক সাংবাদিক।

অন্যদিকে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও দাম্ভিকতার বুলি আওড়ে যাচ্ছে পাকিস্তানিজান্তারা। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনী শেষ আক্রমণ হানতে প্রস্তুত। কোথাও কোথাও ভয়াবহ যুদ্ধও শুরু হয়। সবখানেই মার খাচ্ছে পাকিস্তানিরা। অবশ্য জাতিসংঘের অনুরোধে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা এদিন সকালে সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছিল। উদ্দেশ্য বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের ব্যবস্থা করার জন্য বিমানবন্দর মেরামতের সুযোগ করে দেওয়া।

পরাজয় নিশ্চিত জেনে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকায় সাহায্যের বার্তা পাঠাচ্ছিল, তখন ঢাকা থেকে কোনো সাহায্য পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এদিন লে. জেনারেল নিয়াজী ঢাকা বিমানবন্দর পরিদর্শন করতে এসে দম্ভভরে বলেন, ‘কোনোক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া চলবে না। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঐতিহ্যকে আরো উজ্জ্বল করবে।’ পরে বিমানবন্দরে তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন।

১৯৭১ সালের আজকের এ দিনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈঠক করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানান। যার মধ্যে জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ করাসহ যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির কথা জানানো হয়। একই দিন মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

’৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব দেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ড. এম এ মালেক, যা নাকচ করে দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখিত রিপোর্টে উল্লেখ করেন, ‘মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। শর্তগুলো হচ্ছে- ১. পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ২. বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারা কোনো লিখিত চুক্তি করবে না। ৩. পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে দিতে হবে। ৪. এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দিতে হবে। ৫. ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান এসব প্রস্তাব নাকচ করেন। বরং তিনি পাকিস্তানকে যুদ্ধে সহায়তা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দাবি জানান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্র শুধু জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জোর দাবি জানায়। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র এদিন জানান, ‘জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ ব্যাপারে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’

এদিকে রণাঙ্গনে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে জোর সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। কোনো সংঘর্ষেই পাকবাহিনী যৌথ বাহিনীর সুসংগঠিত আক্রমণের মুখে টিকতে পারছিল না। কোথাও তারা আত্মসমর্পণ করছিল, কোথাও পালিয়ে ঢাকার পথে রওনা হচ্ছিল। এই পালানোর পথে পাকবাহিনী বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা চালায়। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে করতে তারা পিছিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর হানাদাররা ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

জামালপুর গ্যারিসন সম্মিলিত বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে। জামালপুরের হালুয়াঘাট এলাকায় সংঘর্ষের পর পাকিবাহিনীর আর একটি ব্রিগেড প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় শত্রুবাহিনী রাস্তার বড় বড় সব সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ময়মনসিংহে অবস্থানরত শত্রুাহিনীর আর একটি ব্রিগেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনা প্রতিরোধে জামালপুর দখল করে নেয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads