• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
যৌথবাহিনী ঢাকার ১৫ মাইলের মধ্যে

সং‍গৃহীত ছবি

জাতীয়

যৌথবাহিনী ঢাকার ১৫ মাইলের মধ্যে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯

১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বীর বাঙালি। দেশের অধিকাংশ অঞ্চলই কার্যত স্বাধীন। বিশ্বের মানচিত্রে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশটি জন্মের ঠিক আগমুহূর্তে পাক হানাদারদের পক্ষে নগ্ন হয়ে মাঠে নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। প্রভাবশালী এ দুটি দেশ পাকিস্তানের পরাজয় ঠেকাতে মরিয়া। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিয়ে এ দুটি দেশের শেষ চেষ্টা আবারো ব্যর্থ হয়। স্বাধীনতার পথে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়।

১৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রায় প্রস্তুত মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী। ঢাকার ১৫ মাইলের মধ্যে চলে এসেছেন তারা। এদিকে ২৪ ঘণ্টা থেমে থাকার পর এ দিনে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তৃতীয়বারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেওয়ার ফলে বাতিল হয়ে যায়। পাকিস্তানের দোসর শান্তি কমিটি, ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ও স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা বেশিরভাগই অবস্থা বেগতিক দেখে গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু এর মধ্যেও ঘাতক আলবদর চক্র বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে দেশের বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে। যার ভয়ংকর রূপটি প্রকাশ পায় ১৪ ডিসেম্বর।

১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শিগগিরই যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।’ তিনি ঘোষণা করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধ চায় না, যুদ্ধ বাধলে সে তাতে জড়িয়ে পড়বে না।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বললেও এ দিনই বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম  নৌবহর। একই দিন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তৃতীয়বারের মতো  সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেওয়ার ফলে বাতিল হয়ে যায়।

ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী ঢাকার পতন দ্রুততর করার জন্য যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। কেননা ঢাকার পতন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পরাজয় চূড়ান্ত হবে। তবে এত দ্রুত যে ঢাকা আক্রমণ করা সম্ভব হবে, এটা ধারণাতেও ছিল না ভারতীয় সৈন্যদের। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ করা লড়াইয়ের কারণেই এত দ্রুত মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে এগোতে পারছে- এ কথা প্রত্যেক ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা স্বীকার করেন। প্রশংসা করেন মুক্তিবাহিনীর।

১৩ ডিসেম্বর পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দুটো ব্রিগেড এগিয়ে আসে পূর্ব দিক থেকে। উত্তর দিক থেকে আসে জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড এবং টাঙ্গাইলে নামা ছত্রীসেনারা। পশ্চিমে ৪ নম্বর ডিভিশনও মধুমতী পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মার তীরে। রাত ৯টায় মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন। ব্রিগেডিয়ার ক্লের ও ব্রিগেডিয়ার সান সিং সন্ধ্যা থেকে টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন।

রাত সাড়ে নয়টায় টাঙ্গাইল ওয়াপদা রেস্ট হাউসে তারা পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বসেন। আলোচনার শুরুতে মেজর জেনারেল নাগরা মুক্তিবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা যদি আমাদের বিনা বাধায় এতটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য না করতেন, তাহলে আমাদের বাহিনী দীর্ঘ রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ত। রাস্তাতেই অনেক শক্তি ক্ষয় হয়ে যেত।’ লে. কর্নেল সফিউল্লাহর ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে এদিন ঢাকার উপকণ্ঠে ডেমরা পৌঁছায়। সৈয়দপুরে এদিন আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকসেনা।

এ দিনে যৌথবাহিনীর অগ্রবর্তী সেনাদল শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী অতিক্রম করে ঢাকার খুব কাছে পৌঁছে যায়। বালু নদীর পূর্বদিকে পাকবাহিনী শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে রতালে। বাসাবো ও খিলগাঁও এলাকার চারদিকে আগে  থেকেই পাকবাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থাসহ অবস্থান নিয়েছিল।

বগুড়া জেলায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল মহিমাগঞ্জের দুলুর নেতৃত্বে ও সিহিপুরের বাবলু, খালেক, হামিদ, খলিল, নুরুল, শুকু, ফিনু, জগলু, হাল্টু, লিন্টু এবং আরো অনেকের সহযোগিতায় সুকানপুকুর রেলস্টেশনের কাছে সিহিপুরে পাক সেনাবাহী একটি স্পেশাল ট্রেন ডিনামাইটের সাহায্যে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এতে প্রায় দেড়শ পাকসেনা নিহত হয়। কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনী চাওড়া এলাকায় অবস্থানরত পাক সেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। এ সময় ২ পাক সেনা নিহত ও ৩ জন আহত হয়।

৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী একদল পাক সেনাকে রাজাপুর নামক স্থানে এম্বুশ করে। এতে পাকবাহিনীর ৪ সৈন্য নিহত ও ২ জন আহত হয়। মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়ার প্রতাপপুরে পাক সেনাদের অ্যাম্বুশ করে। এতে পাকবাহিনীর ১১ সৈন্য নিহত ও ৪ জন আহত হয়। ২ নম্বর সেক্টরে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা লক্ষ্মীপুর রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করে। আকস্মিক এ আক্রমণে অনেক রাজাকার হতাহত হয়। এ সময় এলাকার জনসাধারণ বিশেষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। ৬ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সহায়ক সৈন্যদের সম্মিলিত বাহিনী ভুরুঙ্গামারী পাকসেনা অবস্থানের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়।

উত্তরাঞ্চলে যৌথবাহিনী গোবিন্দগঞ্জ থেকে ঢাকা মহাসড়ক ধরে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা হয়। বগুড়ায় তখন শত্রুবাহিনীর কয়েক রেজিমেন্ট কামান ও ট্যাংকসহ অবস্থান করছিল। হিলি রক্ষাব্যূহ ছেড়ে আগেই পাকসেনারা বগুড়ায় গিয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। রাতে যৌথবাহিনী চারদিক থেকে বগুড়া শহর ঘিরে ফেলে এবং মধ্যরাতে তিনটি ব্যাটালিয়ন উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব-উত্তর দিক থেকে শত্রুর ওপর আঘাত হানে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads