• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
প্রতিরোধযোগ্য নিউমোনিয়া এখনো শিশু-ঘাতক

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

প্রতিরোধযোগ্য নিউমোনিয়া এখনো শিশু-ঘাতক

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০২০

মাঘের মাঝামাঝি শীতের মৌসুমে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি, ব্রংকাইটিস, এমনকি নিউমোনিয়া হতে পারে। বিশেষজ্ঞরাও এমনটা বলছেন। তাদের মতে, নিউমোনিয়া মৃদু বা হালকা থেকে জীবনহানিকরও হতে পারে। তবে এটি সহজে প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য একটি রোগ।

যদিও দেশের বাস্তবতা বলছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া। পরিসংখ্যান বলছে, ১০ বছর আগের তুলনায় সম্প্রতি নিউমোনিয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো প্রতি ঘণ্টায় এ রোগে একজন করে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।

২০ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’-এর প্রাথমিক ফল প্রকাশ করে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)। এই জরিপকে দেশের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সবচেয়ে বড় জরিপ বলে বিবেচনা করেন বিশ্লেষকরা। জরিপে নিউমোনিয়া এবং সংক্রমণকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ‘মেজর কিলার’ বলে উল্লেখ করা হয়।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, এক মাস থেকে ১১ মাস বয়সী যত শিশু মারা যায়, তার মধ্যে অর্ধেক শিশু মারা যায় শুধু নিউমোনিয়া এবং সিরিয়াস ইনফেকশনে। একইসঙ্গে নবজাতক (শূন্য থেকে ২৮ দিন) মৃত্যুর তিন চতুথাংর্শ ঘটে অ্যাস্ফিক্সিয়া (জন্মকালীন শ্বাসরোধ), নিউমোনিয়া বা বড় কোনো সংক্রমণ, অপরিণত এবং কম ওজনের জন্য।

স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শীত মৌসুমের শুরুতে গত ডিসেম্বরে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে ১৭১ জন। গত মঙ্গলবার ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে আরো ১৬০ জন। নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৭২ জন।

নবজাতক মৃত্যুর ঘটনা থেকে জানা যায়, অপরিণত এবং কম ওজনের কারণে ১৯ শতাংশ, জন্মকালীন শ্বাসরোধ এবং জন্মকালীন ইনজুরি রয়েছে ২৯ শতাংশ এবং নিউমোনিয়া ও সংক্রমণ রয়েছে ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া এক মাস থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয় ৪৮ শতাংশ, ডায়রিয়াতে ১৪ শতাংশ এবং জন্মগত ত্রুটিতে ছয় শতাংশ। একইসঙ্গে ১২ মাস থেকে ৫৯ মাস অর্থাৎ এক বছর থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ ১৩ শতাংশ, ডায়রিয়াতে ছয় শতাংশ এবং পানিতে ডুবে মারা যায় ৫৯ শতাংশ। সেভ দ্য চিলড্রেন সম্প্রতি জানায়, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দুটি শিশু। প্রতিষ্ঠানটির ন্যাশনাল সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস রিপোর্ট অব নিউমোনিয়া শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এখনো মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া।

তবে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭২ জন যে শুধুই নিউমোনিয়ার জন্য মারা গেছে বিষয়টি তা নয়। নিউমোনিয়ার সঙ্গে অন্যান্য রোগের উপস্থিতিও ছিল। ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ বলেন, ‘একটি রোগী যদি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়, তারপরও সে শুধু নিউমোনিয়াতে মারা যায় না। এর সঙ্গে অন্যান্য সমস্যাও ছিল, অন্য রোগ যোগ হয়েই সে মারা যায়।’

হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ সফি আহমেদ বলেন, শীতজনিত কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ নিয়ে প্রতিদিনই অনেক শিশু রোগী হাসপাতালে আসছে। অন্যসব রোগীর সংখ্যা খুবই কমে গেছে। আগত শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের হার সর্বাধিক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার বলেন, সাধারণত জানুয়ারিতে ঠান্ডাজনিত রোগী কমে আসে। কিন্তু এবার শীতের প্রকোপ বেশি থাকায় এবং বৃষ্টির কারণে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ সমস্যা মোকাবেলায় সরকারি হাসপাতালে নির্দেশনা দেওয়া আছে। আবার জনগণকে সচেতন করতেও নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের নিউমোনিয়া স্যানিটারি কমিটমেন্ট অ্যাডভাইজার সাব্বির আহমেদ বলেন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া হলেও নবজাতক মৃত্যুর কারণ আবার ভিন্ন। আর বাংলাদেশের ‘আন্ডার ফাইভ ডেথ’র ষাট শতাংশই হচ্ছে নবজাতক মৃত্যু। এ জন্য এখন দেশের প্রধান ফোকাস হচ্ছে নবজাতক মৃত্যুর দিকে। যার কারণে পাঁচ বছরের কম শিশু মৃত্যুর দিকে ফোকাসটা কম দেওয়া হচ্ছে-এটিও একটি বড় কারণ।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু ও বৃদ্ধ নিউমোনিয়ার কারণে মারা যায়। আর শীতের সময় তা বৃদ্ধি পায়।

শিশু মৃত্যুর জন্য নিউমোনিয়াকে ‘নাম্বার ওয়ান লিডিং কজ’ বলে অভিহিত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা। তিনি বলেন, আগে শিশু মৃত্যুর প্রধান তিন কারণ ছিল, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং অপুষ্টি। কিন্তু এখন ডায়রিয়াতে অসংখ্য শিশু আক্রান্ত হলেও তাতে একেবারেই মৃত্যু নেই, অপুষ্টিজনিত মৃত্যুও কমেছে।

নিউমোনিয়ার প্রতিরোধ প্রসঙ্গে ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘এর প্রথম প্রতিরোধ হচ্ছে, ভ্যাকসিনের বাইরে যেন কোনো শিশু না থাকে, এটা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে অপুষ্টিজনিত শিশুদের নিউমোনিয়া হওয়ার শঙ্কা অনেক বেশি, তাই নিউমোনিয়া কিছু কমাতে হলেও অপুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে এবং যদি দ্রুত শ্বাস এবং জ্বর হয়, তাহলে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত শিশুকে যদি প্রথম দুই দিনের মধ্যে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া যায়, তাহলে মৃত্যুর হার কমে যাবে। যদি সাত দিন পরে যাওয়া হয়, তাহলে মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যাটারনাল, নিউনেটাল, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলোসেন্স হেলথ প্রকল্পের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক বলেন, ‘নিউমোনিয়াতে মৃত্যুর হার আগে যা ছিল, তার চেয়ে অনেক কমেছে এবং একে আরো কমাতে হবে। তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিউমোনিয়ার সঙ্গে আরো কারণ রয়েছে।’ তিনি জানান, নিউমোনিয়াতে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে সময়মতো চিকিৎসা শুরু না করা। এখানে কিছুটা সচেতনতার অভাব রয়েছে। নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার পরই যদি তার চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে কিন্তু সে সিভিয়ার নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে পারছে না, আর সিভিয়ার নিউমোনিয়াতেই শিশুরা মারা যাচ্ছে।

অ্যাজমা সেন্টারের প্রধান মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, এখন শিশুরা মূলত নিউমোনিয়া ও ব্রংকাইটিসের সমস্যা নিয়ে আসছে। আগের তুলনায় বর্তমানে রোগী দ্বিগুণের কাছাকাছি। আগে গড়ে দিনে ৪০ রোগী আসত। তিনি জানান, বাইরের দূষণের (ধোঁয়া, ধুলা, ফুলের রেণু) পাশাপাশি ঘরের ভেতরকার দূষণের কারণেও শিশুরা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছে।

সম্প্রতি ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, নিরাময়যোগ্য এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য রোগ নিউমোনিয়াতে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ২২শ শিশু মারা যায়। এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জোরালো বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি এবং বাড়তি বিনিয়োগ জরুরি। যেখানে শিশুরা আছে সেখানে শুধু সাশ্রয়ী সুরক্ষা ও প্রতিরোধমূলক এবং চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই আমরা সত্যিকারভাবে লাখো জীবন বাঁচাতে সক্ষম হব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads