• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
৭ মার্চের ভাষণ যেভাবে রক্ষা করেন আমজাদ

ফাইল ছবি

জাতীয়

৭ মার্চের ভাষণ যেভাবে রক্ষা করেন আমজাদ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০২০

একাত্তরে অনেকেই যখন নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, তখন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ জীবনবাজি রেখে রক্ষা করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম ডিভিশনের সহকারী ক্যামেরা পারসন আমজাদ আলী খন্দকার। কালজয়ী সেই ভাষণ যারা রেকর্ড করেছিলেন, তাদের অন্যতম তিনি।

৭৭ বছর বয়সী আমজাদ আলী খন্দকার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড এবং রক্ষার সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।

আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ‘৬ মার্চ আমাদের পরিচালক আবুল খায়ের মহিবুর রহমান আমাদের ডেকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করতে বলেন। আমরা মোট সাতজন ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড করেছিলাম। যার মধ্যে আমি আর মমিন সাহেব দুজনে একটি ক্যামেরা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করি। রউফ সাহেব এবং তৌহিদ আরেকটি ক্যামেরা দিয়ে রেসকোর্স ময়দানের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে উপস্থিত জনতার ভিডিও করেন। একজন সহকারী ক্যামেরাম্যান অডিও রেকর্ড করেন। আমাদের সঙ্গে দুই লাইটম্যানও ছিল।’

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড শেষে রাতে আমরা অফিসে আসি। ভাষণের রেকর্ড করা ফিল্ম অফিসে রাখি। আমাদের অফিসে ল্যাব ছিল না। এফডিসি থেকে ফিল্ম প্রিন্ট করে আনতে হতো। তখন বঙ্গবন্ধুর নামে কোনো কিছু, কোথাও লেখা যেত না। তাই আমরা কৌশল করে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভিডিও সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, নির্বাচন, অথবা অন্য কোনো ডকুমেন্টারির নাম দিয়ে গোপনে এফডিসি থেকে ভিডিও প্রিন্ট করে আনতাম এবং চিহ্ন দিয়ে রাখতাম কোনটাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভিডিও আছে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রেকর্ড সচিবালয় থেকে যেভাবে ভারতে নিয়ে যাওয়া হলো, সেই স্মৃতি হাতড়ে আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর অনেক ঘটনা ঘটে গেল। বঙ্গবন্ধুকে আটক করা হলো। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ করল। সবাই যে যার মতো পালাতে লাগল। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল খায়ের সাহেব আমাকে ডেকে বলেন, আমজাদ তোমাকে এখনই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ছবি নিয়ে। তিনি আমাকে একটি ট্রাঙ্ক কেনার জন্য টাকা দিলেন। আমি সদরঘাট থেকে কালো রঙের ৪২ ইঞ্চি একটা ট্রাঙ্ক কিনে আনলাম। ট্রাঙ্কের ভেতর বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ছবি এবং ৭ মার্চের ভাষণ ভর্তি করলেন। তখন আমি বাবাকে বলে এলাম, ঢাকার বাইরে যাচ্ছি অফিসের কাজে। কয়েক দিন দেরি হবে যেন চিন্তা না করে।

তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে যান, ‘বাবাকে বলে আসার পর খায়ের সাহেব আমাকে তার রুমে নিয়ে গেলেন। এরপর তিনি আমার হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ‘আমজাদ! আল্লাহাফেজ।’ খায়ের সাহেবের চোখগুলো তখন অনেক বড় বড় মনে হচ্ছিল। তিনি ভেবেছিলেন আমি হয়তো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মারা যেতে পারি।

তিনি বলতে থাকেন, ‘তখন সচিবালয়ের প্রতিটা গেটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাহারায় ছিল। শুধু সেকেন্ড গেটে সার্জেন্ট ফরিদ নামে একজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। সেকেন্ড গেট দিয়ে সে সময় গাড়ি সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকতে পারত, কিন্তু বের হতে পারত না। সার্জেন্ট ফরিদকে তখন বলা হলো আমরা এই কাজ করব, আমাকে একটু বের করে দিয়েন।’ তখন উনি বলেন, ‘আপনি আমাকে ইঙ্গিত দিলে আমি আপনাকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।’ আমি তখন পরিচিত কয়েকজনকে বললাম, ‘আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসতে। কিন্তু তারা শুধু ট্রাঙ্কটা বেবিট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিল, কেউ আমার সঙ্গে এলো না। আমি সার্জেন্ট ফরিদকে ইশারা দিতেই তিনি পল্টনের দিক থেকে যে গাড়িগুলো আসে, সেগুলোকে হাতের ইশারায় বন্ধ করে দিয়ে আমার বেবিট্যাক্সিকে সিগন্যাল দিয়ে সচিবালয় থেকে বের করে দিলেন।

তিনি আরো বলেন, ‘প্রেস ক্লাবের উল্টো পাশে আমেরিকান সেন্টারের কাছে এসে দেখি ট্রাকের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফিতা লাগানো মেশিনগান তাক করে বসে রয়েছে। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে সেনাবাহিনীর সামনে দিয়েই পার হলাম। কার্জন হলের পাশ দিয়ে চকবাজার হয়ে সোয়ারীঘাটে পৌঁছালাম। সোয়ারি ঘাটে একজন কুলিকে দিয়ে ট্রাঙ্ক নৌকায় তুললাম। এরপর জিনজিরা বাসস্ট্যান্ডে যাই। সেখানে দেখি মানুষ জান বাঁচাতে এদিক-সেদিক পালাচ্ছে। রাস্তায় দেখলাম অনেক মানুষকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে।

আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ‘জিনজিরা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতেই দেখি একটি বাস ছেড়ে যাচ্ছে। আমি তখন বাসের পিছনে হাত দিয়ে জোরে জোরে থাপ্পড় দিলাম। ড্রাইভার তখন আমাকে দেখে বাসটি থামায়। ড্রাইভার আমাকে হাতের ইশারায় বাসের ছাদে উঠতে বলল। আমার ভেতর তখন ভয় কাজ করছে যে, আমার পেছনে কেউ রয়েছে কি না। ভয়ে ভয়ে বক্সগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে নামলাম। এরপর যাব কিসে? দেখি রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই। তখন এক ঘোড়াওয়ালাকে দেখে বললাম, ‘বাবা আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারবা? এরপর ঘোড়ার পিঠে ট্রাঙ্ক রেখে আমরা দুজন দুই পাশ থেকে ট্রাঙ্ক ধরে হাঁটতে লাগলাম। এভাবে প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার গেলাম। নিরাপত্তার ভয়ে নৌকায় যাইনি।

তিনি বলেন, ‘দোহার থানার জয়পাড়া গ্রামের মজিদ দারোগার বাড়িতে ট্রাঙ্ক রাখি। মজিদ দারোগাকে খায়ের সাহেব আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন। সেদিন আমি আমার নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভাবিনি। নিজের পরিবার-পরিজন বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের কথাও ভাবিনি। শুধু দেশ এবং বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার কারণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি এই কাজটি করেছিলাম। খায়ের সাহেব আমাকে খুঁজতে খুঁজতে দোহারে এসে পৌঁছান।’

তিনি বলেন সব ঐতিহাসিক ঘটনাবলি, ‘আবার যখন দোহার থানায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পৌঁছে যায়, তখন খায়ের সাহেব নিরাপত্তার জন্য দোহার থেকে আরো ভেতরে চরকোষা গ্রামের অমেদ খাঁ এবং দানেশ খাঁ নামের দুই ভাইয়ের বাড়িতে ধানের গোলার ভেতরে ট্রাঙ্কটি লুকিয়ে রাখেন। এর পরের দিন খায়ের সাহেব ভারতে চলে যান।

আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ‘ভারতে গিয়ে খায়ের সাহেব ইন্ডিয়ান হাইকমিশন এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, ধানের গোলা থেকে ট্রাঙ্কটি মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে ভারতে নিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের ভিডিও ক্যাসেট ভারতেই ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খায়ের সাহেব দেশে ফিরে আসার সময় বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণও সঙ্গে নিয়ে আসেন।

এভাবেই আমজাদ আলী খন্দকার, আবুল খায়ের মুহিবুর রহমানসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রক্ষা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। যে ভাষণের মাধ্যমে তিনি বাঙালিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। যে ভাষণ আজ শুধু বাঙালি জাতির নয়, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই সেল ফাইট অন দ্য বিস : দ্য স্পিস দ্যাট ইন্সপায়ার্ড হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্থান পেয়েছে। অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে এই ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বে সর্বাধিকবার প্রচারিত ও শ্রবণকৃত ভাষণ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads