• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
কাজ বন্ধ, মহাসংকটে শ্রমজীবী মানুষ

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

কাজ বন্ধ, মহাসংকটে শ্রমজীবী মানুষ

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ০১ এপ্রিল ২০২০

অন্যের বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন জমেলা বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে গত বছর রংপুর থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। বিভিন্ন বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর কাজ করে ভালোই চলছিল তার সংসার। মাস শেষে কিছু নগদ টাকা ছাড়াও প্রতিদিন খাবার পেতেন জমেলা। বাসাবাড়িতে কাজ শেষে কিছু খাবার নিয়ে যেতেন সন্তানদের জন্য। কিন্তু করোনার কারণে সব কাজ বন্ধ। কোনো বাসায়ই আর ঢুকতে পারছেন না তিনি। এখন সন্তানদের মুখে ঠিকমতো খাবারও দিতে পারছেন না জমেলা। হাতে যা নগদ টাকা ছিল, তাও শেষ প্রায়। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন এই নারী। শুধু জমেলা নন, তার মতো নিম্ন আয়ের অগণিত মানুষ খাবারের চিন্তায় অস্থির।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশের মানুষকে নিজ নিজ ঘরে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে উপার্জন না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন দিনমজুর ও হতদরিদ্ররা। কর্মহীন হয়ে পড়ায় করোনা আতঙ্কের পাশাপাশি জীবিকা নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষরা।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিম্ন আয়ের এসব শ্রমজীবী মানুষের পাশে রাষ্ট্রকেই দাঁড়াতে হবে। খুব বড় আকারে সেবা কর্মসূচি নিয়ে নামতে হবে রাষ্ট্রকে। এছাড়া সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘদিন এসব নিম্ন আয়ের মানুষ বেকার থাকায় বাড়তে পারে অপরাধপ্রবণতাও। খাবার বা আর্থিক সংকটে পড়ে তারা চুরি, ছিনতাই বা লুটতরাজও করতে পারে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মৌচাক এলাকায় কথা হয় দিনমজুর রহমত আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কাজ তো এখন একদমই নাই, তার ওপর রাস্তায় বের হলে পুলিশে ধরে। সরকার নাকি সহায়তা করবে, সেগুলো কীভাবে পাওয়া যায়, কোথা থেকে দেয়, তাও জানি না। আগে মাঝে মাঝে শাহবাগে ফ্লাস্কে করে চা আর সিগারেট বিক্রি করে কিছু ইনকাম করতাম, এখন তাও নাই। সংসারটা কীভাবে চালাব মাথায় আসছে না।’

রিকশাচালক বিল্লাল হোসেন বলেন, কোনো যাত্রী নেই। সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২০০ টাকাও আয় হয়নি। অন্য সময় এতক্ষণে এক হাজার টাকা আয় হতো। তিনি বলেন, দিনশেষে নিজে খেতে হবে আবার পরিবারের জন্য কিছু টাকা গ্রামেও পাঠাতে হবে। কোনো জমানো টাকাও নেই যে তা দিয়ে চলব। এখন সব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু রিকশাচালক বা দিনমজুর নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে পরিবহন খাতে যারা বাস-মিনিবাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার বা হেলপার হিসেবে কাজ করেন তারাও মজুরি পান প্রতিদিনের ট্রিপ বা যাতায়াতের ওপর। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিপাকে আছেন তারাও। আর অটোরিকশা ও রাইড শেয়ারিং-এ যারা কাজ করতেন তাদের অবস্থাও নাজুক।

মালিবাগ-মৌচাক এলাকায় ঘুরে ঘুরে জুতা সেলাই ও পলিশের কাজ করেন ফরিদপুরের দিলীপ কর্মকার। কিন্তু মানুষ ঘরে ঢুকে যাওয়ায় এবং দোকানপাট বন্ধ থাকায় গত কয়েক দিন ধরে তার কোনো উপার্জন নেই। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কারো বাড়িতে ঢুকতে মানা। মাসের শেষদিকে এসে এই ধরনের পরিস্থিতির কথা সে ভাবতেও পারেনি। খাবার, ওষুধ ও ঘর ভাড়ার টাকা কোথায় পাবেন— এর কোনো উত্তর নেই নিম্ন আয়ের এই দিলীপের।

মতিঝিল শাপলা চত্বরে কথা হয় রিকশাচালক মনসুর আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হামার করার কিছু নাই। একবেলা ইসক্যা না চালাইলে খামো কী। গরিবের ঘরে খাবার ব্যবস্থা করি দ্যাশোত কার্প্যু করলে ভালো হইল হয়।’

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। আর এই করোনা পরিস্থিতিতে শুধু তারাই নন, যারা চাকরিজীবী নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির তারাও আছেন সংকটে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে শুধু বাংলাদেশেই না সার্বিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রার ওপরে, পেশাগত কর্মকাণ্ডের ওপরে, অর্থনীতির ওপরে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে কিছুটা পড়েছেও।

দীর্ঘমেয়াদি কর্মহীন থাকার কারণে অপরাধপ্রবণতা বাড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে এই অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, যখন মানুষের ঘরে যখন খাবার থাকবে না, খাবার কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে না তখন অপরাধপ্রবণতা বাড়বেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত ছিনতাই, চুরি, অর্থ বা সম্পদ লুট হতে পারে। শ্রমজীবীরা খাবারের জন্য এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে। আমরা যদি তাদের খাবারের নিশ্চয়তা দিতে না পারি তাহলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে ধনীদের এগিয়ে আসতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads