• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
জীবন তো বাঁচাতে হবে

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

করোনা ভাইরাস

জীবন তো বাঁচাতে হবে

  • এ এইচ এম ফারুক
  • প্রকাশিত ০২ এপ্রিল ২০২০

গরিবের ঘরে জন্ম। নিজেও গরিব হয়ে রইলাম। সেই পাপেই রাস্তায় বের হতে বাধ্য হয়েছি। করোনা ভাইরাস রোধে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া নিষেধ। কিন্তু জীবন তো বাঁচাতে হবে। ঘরে বয়স্ক মা, বউ, দুই ছেলেমেয়ে আছে। তাদের ক্ষুধার জ্বালা মেটানোর দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। আমি না বের হলে তাদের পেটে কে ভাত দেবে? ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়ার আগে সরকারের উচিত ছিল, আমার মতো খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া।

কথাগুলো বলছিলেন ভ্যানচালক মো. আমজাদ (৪৪)। পরিবার নিয়ে রাজধানীর মুগদায় ৭ হাজার টাকায় ২ কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। রিকশা প্যাডেল চালিত ভ্যান চালিয়ে পরিবারে খাবার ও ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগান। সাধারণ ছুটিতে স্কুল বন্ধ, বাচ্চারাও ঘরে বন্দি। কিন্তু প্রায় ১ সপ্তাহ স্বেচ্ছা বন্দি জীবনের এ পর্যায়ে ঘরে খাবার শেষ। তাই জীবন-জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হয়েছেন, যদি কোনো কাজ পান।

গতকাল বুধবার বিকেলে যখন তার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয় তখন তিনি জানালেন দুপুরের আগে শ্যামপুর আড়ত থেকে এক দোকানিকে মুদিমাল এনে দিয়ে ২০০ টাকা পেয়েছেন। দুপুর পর্যন্ত আর কোনো কাজ জোটেনি। বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে ফের বের হলেন নতুন খেপের আশায়।

চাঁদপুর থেকে জীবিকার সন্ধানে প্রায় চৌদ্দ বছর আগে ঢাকায় আসা আমজাদ জানালেন তার অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, এই ঢাকায় জরুরি অবস্থা দেখেছি। রাজনৈতিকভাবে হরতাল ও অচলাবস্থা দেখেছি। কিন্তু এবারের এই করোনায় যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি  হয়েছে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।

বাবার মৃত্যুর পর নিজের কাঁধে সংসারের বোঝা। বৃদ্ধ মাকে নিয়ে নিজের সংসারের ৫ জন খানেওয়ালা। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আমজাদের ভাষ্য, আশেপাশে কিছু ত্রাণ দেওয়ার খবর পাই। কিন্তু যাই না। কখনো হাত পাতিনি কারো সামনে। পরিশ্রম করে পরিবারের আহার জোগাড় করার চেষ্টা করি।

তিনি আরো বলেন, শুনেছি বিদেশে সরকার বাসায় বাসায় খাবার-ওষুধ ও প্রয়োজনীয় পন্যা পৌঁছে দেয়। যদি আমাদের সরকারও এভাবে বাসায় খাবার ও জরুরি জিনিস পৌঁছে দিত তবে এই ঝুঁকি নিয়ে বাসা থেকে বের হতাম না।

কথা হয় সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক সুজা উদ্দিনের (৫৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশের পর ২৬ তারিখ থেকে বাসায় বসা। মহাজনও গাড়ি জমা রেখে দেয়। কিন্তু যা জমা ছিল শেষ হয়ে গেছে। তাই গতকাল (গত মঙ্গলবার) মহাজনকে অনুরোধ করে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। আজ দুদিনে মাত্র ১২শ টাকার ভাড়া পেয়েছি। নিয়মানুযায়ী একদিনের জমা ৯০০ টাকা। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কেম্নে কী হবে জানি না।

সুজা বলেন, অফিস-আদালত এবং স্কুল-কলেজ বন্ধ। ফলে যাত্রী নেই। সড়কে মানুষ নেই বললেই চলে। মাঝেমধ্যে বাজার সদাই করতে বের হওয়া দু-একজন এবং হাসপাতালে যাবার জন্য দু-একজন বের হয়। বাকরাি আমার মতো শ্রমজীবী মানুষ। কাজের সন্ধানে বের হয়েছে।

করোনা ঝুঁকির বিষয়ে জানেন কি না জানতে চাইলে সুজা বলেন, জানি; কিন্তু কী করব। পেটের দায়ে ঘরে বসে থাকতে পারছি না। তাই পথে বের হয়েছি। বের হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

মুগদার মান্ডায় ষাটোর্ধ্ব এক দম্পতিকে সড়কের পাশে বসে কাঁচা তরিতরকারি বিক্রি করতে দেখা যায়। জামালপুর থেকে প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকায় এসে সবজির ব্যবসা শুরু করার কথা জানালেন কর্তা।

দেশে-বিদেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকলেও দেশে ভয়াবহ একটা ভাইরাস এসেছে তা জানেন।

সাধারণ ছুটিতে সব বন্ধ, কেন বয়োজ্যেষ্ঠ স্বামী-স্ত্রী বের হয়েছেন? এমন প্রশ্নে বলেন, মামা খাব কী। সব বন্ধ। ঘোষণার পর কয়েকদিন বের হইনি। কিন্তু আমাদের তো জমা নেই। দিনের খাবার দিনে জোগাই। তাই বাধ্য হয়ে বের হতে হলো।

দোকানি বৃদ্ধা বলেন, বুড়া মানুষ, একা ছাড়তে ভয় পাই। তাই আমিও সঙ্গে আসি। প্রথম কয়দিন ভ্যান নিয়ে আড়তেও যেতে দেইনি। কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে বের হতে হচ্ছে।

তারা জানালেন সড়কে আগের মতো মানুষ নেই। অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। হঠাৎ হঠাৎ এক-দুজন কাস্টমার আসেন। তাই সারা দিনই বসে থাকি।

এক প্রশ্নের জবাবে এই দম্পতি জানান, শুনেছি কেউ কেউ নাকি চাল-ডাল খাবার বিলাচ্ছে। তবে সেসব আমাদের কপালে জোটেনি।

গৃহকর্মীর কাজ করেন ফাতেমা (৪২)। তিনি জানান, অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। করোনা ভাইরাসের ভয়ে বাসা থেকে কাজে না করে দিয়েছে। এখন কাজ নেই। তাই বেকার। যা বেতন পাওনা ছিল তা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এ মাসে কাজ করতে না পারলে না খেয়ে মরতে হবে। ফাতেমা বলেন, কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতে ঠিক না হলে সন্তানদের নিয়ে কী করব ভেবে পাচ্ছি না।

করোনা বিস্তার রোধে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে রাজধানীসহ পুরো দেশ অঘোষিত ‘লকডাউন’। ইতোমধ্যে ছুটির মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে।

ছুটি ঘোষণার পর থেকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া নাগরিকদের ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। দুই জনের একসঙ্গে চলাচলেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এ অবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন বিপাকে। কিন্তু অঘোষিত ‘লকডাউন’ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা না মেনেই বের হচ্ছেন তারা, তবে তেমন কাজ মিলছে না তাদের। তাদের মতো আরো অনেক শ্রমজীবী মানুষের দেখা মিলেছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে। একই অবস্থা তাদেরও। রয়েছে করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) আতঙ্ক।  কিন্তু জীবন ও জীবিকার তাগিদে কোনো প্রকার সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই তারা রাস্তায় নামছেন।

সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় বের হতে নিষেধ করেছেন তারা। কোথাও মানুষের জটলা দেখলে তা ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত সর্বশেষ ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনে সাড়ে ৬ লাখের মতো মানুষ বস্তিতে বসবাস করছেন। জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় ভাসমান শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আরো দেড় লাখ। রিকশাচালক ও গণপরিবহনের সঙ্গে যুক্ত আছে আরো ৬ লাখ মানুষ। এর বাইরে বিভিন্ন পেশার স্বল্প আয়ের মানুষ আছে প্রায় ১৬ লাখ। এদের অধিকাংশেরই প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভর করে সংসার চলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের প্রত্যেকের আয় রোজগার বন্ধ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads