• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
বন্ধ-খোলার তামাশায় ঝুঁকিতে কয়েক লাখ পোশাককর্মী

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

বন্ধ-খোলার তামাশায় ঝুঁকিতে কয়েক লাখ পোশাককর্মী

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০২০

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন অংশে চরম সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে গত দুদিনে ঘটে যাওয়া পোশাক কারখানা খোলা-বন্ধ খেলায় সমন্বয়হীনতা আরো স্পষ্ট হয়েছে। সরকার এবং বিজিএমইএ’র এমন দায়িত্বহীনতায় চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে কয়েক লাখ গার্মেন্টকর্মী। এর ফলে শুধু তারাই নয়, পুরো দেশই এখন আরো করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকিতে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে তুমুল প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রোববার থেকে গার্মেন্ট খোলা হবে এমন খবর পেয়ে গত দুদিনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে ঢাকা ও আশপাশের গার্মেন্টগুলোতে হাজির হয়েছে কয়েক লাখ পোশাককর্মী। এতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে— গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনায় মুখে গত শনিবার রাতে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্ট বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক। এদিকে বেতন ও চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে পড়েছেন খাবারের সমস্যায়। অন্যদিকে শনিবার গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঢাকা অভিমুখে ঢল ঠেকাতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ নির্দেশের পর গতকাল রোববার ঢাকা প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে কড়াকড়ি আরোপে নিজ বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি)।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যদিও উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা খোলা রাখার সুযোগ দেওয়া হয় জনপ্রশাসনের প্রজ্ঞাপনেই। গত ১ এপ্রিল সরকারি ছুটি বাড়িয়ে দেওয়ার প্রজ্ঞাপনে এই সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এ সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ থাকবে। দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সচিবালয়ে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও তার পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এর সঙ্গে মার্চের ২৯, ৩০, ৩১ এবং এপ্রিলের ১, ২ তারিখ সাধারণ ছুটি সংযুক্ত করা হয়েছে। এরপর ৩ ও ৪ এপ্রিল আবার সাপ্তাহিক ছুটি। এছাড়া বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব এবং সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত হবে।

এ সময় কাঁচাবাজার, ওষুধের দোকান, খাবারের দোকান ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান ছাড়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে সব ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মসজিদে না গিয়ে বাড়িতে নামাজ পড়ার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়। গণপরিবহন বন্ধ না করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় গ্রামমুখী হয় অসচেতন মানুষ। এতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিলে গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। এই ছুটি শেষ হওয়ার আগেই করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে গত ১ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আরেকটি প্রজ্ঞাপনে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে দেয় সরকার। এই প্রজ্ঞাপনে প্রয়োজনে ওষুধ শিল্প, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা চালু রাখা যাবে— এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেয় গার্মেন্ট মালিকরা। তারা ৫ তারিখে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। বেতন ও চাকরির অনিশ্চয়তার ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষা করে এমনকি গণপরিবহন না পেয়ে হেঁটে কর্মস্থলের দিকে রওনা দেয়। বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার ও বিজিএমইএ। রাজধানীমুখী মানুষের ঢল ঠেকাতে শনিবার রাতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

 

চ্যালেঞ্জ স্বাস্থ্যের, প্রণোদনা ব্যবসায়ীদের

করোনাভাইরাসে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দেশ আমেরিকা। দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে। মারা গেছে প্রায় ৮ হাজারের বেশি। দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত। আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশটি এক লাখ ৭০ হাজার ভেন্টিলেটর নিয়ে যুদ্ধ করছে। এরপরেও তারা বলছে, মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখে সীমাদ্ধ রাখতে পারলেও তারা খুশি। অন্যদিকে বর্তমানে আমাদের দেশের মোট ভেন্টিলেটরের সংখ্যা মাত্র ৭৫০টি। করোনায় আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিতরা মানসম্মত পিপিই পাচ্ছে না। এই দুর্যোগে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে তাদের জন্য নেই কোনো প্রণোদনা। ফলে তারা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা নিজেদের নিরাপত্তার অভাবে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছেন। তবে সরকারের পক্ষ বিভিন্ন সেক্টরের জন্য নতুন করে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হলেও তাদের জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই।

দুই লাখ কর্মী ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকলেও উপেক্ষিত পুলিশ : করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে চরম সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে নিজেদের কর্মকর্তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বৈরিতা। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরছেন। দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং দিকনির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য ও সেবা বিভাগ। এতে সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২৬ জন সচিব থাকলেও সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) রাখা হয়নি। করোনা মোকাবিলায় দুই লাখ পুলিশ সদস্য কাজ করলেও পুুলিশপ্রধানকে কমিটিতে না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পুলিশ ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের ফেসবুক পেজে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের এই কমিটিতে পুলিশপ্রধানকে অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এছাড়াও সিটি করপোরেশন জেলা/উপজেলায় করোনা প্রতিরোধে গঠিত কমিটিতে পুলিশ প্রশাসনকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এমন অভিযোগ মাঠ প্রশাসনে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের। গত ১ এপ্রিল সরকারি ছুটি বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই প্রজ্ঞাপনে সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, জেলা প্রশাসক, ইউএনওসহ ১৬ জনকে দেওয়া হলে দেওয়া হয়নি সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার পুলিশ মহাপরিদর্শককে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পুলিশ ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা।

রাজধানীমুখী মানুষের ঢল থামাতে আইজিপিকে নির্দেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর : বিজিএমইএ গার্মেন্ট খোলার ঘোষণা দিলে রাজধানীর আশপাশে ঢল নামে পোশাক শ্রমিকদের। জীবিনের ঝুঁকি নিয়ে তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে সেটি সামাজিক ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। পরে রাজধানীমুখী মানুষের ঢল থামাতে শনিবার রাত ১০টার দিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারীকে নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। রাতে মন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেন, আর কাউকে যেন রাজধানীতে ঢুকতে না দেওয়া হয় সেজন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পোশাক শ্রমিকদের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য দিতে বিজিএমইএকে বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বিজিএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, এখন পর্যন্ত যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা শ্রমিক ও শিল্পের স্বার্থ বিবেচনা করে নেওয়া হয়েছে। তবে কার্যাদেশ বাতিলসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আমরা শ্রমিকদের আসতে বলেছি। তিনি বলেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন এ পরিস্থিতি কীভাবে হ্যান্ডেল করা যায় তা নিয়ে ভাবছি আমরা।

কল কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বলেন, সরকারের ছুটির প্রজ্ঞাপনে কিন্তু রপ্তানিমুখী শিল্প খোলা রাখার ব্যাপারে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী কেউ কারখানা খুলে রাখলে আমরা অভিযান চালাতে পারি না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানার মালিকদের আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল।

সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার ও বিজিএমইএ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। এখানে চরম সমন্বয়হীনতাও দেখা গেছে। চরম দুর্যোগের এ সময় এ ধরনের সমন্বয়নহীনতা চরম ঝুঁকিতে পড়বে দেশের মানুষ। তিনি বলেন, সরকরকে এ সময় আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads