• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
ব্যবসার উদ্দেশ্যে টেস্ট ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে প্লাজমা

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

ব্যবসার উদ্দেশ্যে টেস্ট ছাড়াই দেওয়া হচ্ছে প্লাজমা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

প্লাজমা দেওয়ার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট করা আবশ্যক হলেও অ্যান্টিবডি টেস্ট ছাড়াই প্লাজমা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি নন-কোভিড রোগী থেকেও প্লাজমা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রক্তের তরল, হালকা হলুদাভ অংশকে প্লাজমা বা রক্তরস বলে। তিন ধরনের কণিকা ছাড়া রক্তের বাকি অংশই রক্তরস। মেরুদণ্ডী প্রাণীর শরীরের রক্তের প্রায় ৫৫ শতাংশই রক্তরস। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশে প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ হতে সহায়ক ভূমিকা পালন করায় প্লাজমা থেরাপি আশার আলো দেখায় বাংলাদেশের চিকিৎসকদের। গুরুতর রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল পাওয়ায় এর প্রতি ঝোঁকও বেড়েছিল। তবে দিন দিন সে ঝোঁক ব্যবসার দিকে রূপ নিচ্ছে, মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। এমনকি সর্বোচ্চ দুই ব্যাগ প্লাজমা দেওয়া যায় বলে চিকিৎসকরা জানালেও ব্যবসার উদ্দেশে কোনো কোনো চিকিৎসক পাঁচ ব্যাগ প্লাজমা দিতে হবে বলেও রোগীর স্বজনদের জানাচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্লাজমা থেরাপিকে শুধু পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে রাখার কথা বলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন গাইডলাইন দিয়েছে। যেখানে একে ‘ইনভেস্টিগেশনাল থেরাপিউটিকস’ বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এটা সব রোগীর ওপর নিশ্চিতভাবে কাজ করছে এমন প্রমাণ নেই। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, এখনো আমাদের নিজেদের কোনো গাইডলাইন নেই। করোনাভাইরাসের সব চিকিৎসা এখনো পরীক্ষামূলক। প্লাজমা থেরাপিও তার ব্যতিক্রম নয়।

দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া প্লাজমা থেরাপি না দিতে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। নেই কোনো মনিটরিং সিস্টেম। যে কারণে চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের চাহিদাকে কেন্দ্র করে চলছে প্লাজমা ব্যবসা। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি ইফেক্টিভ বলার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্লাজমা থেরাপি রিকমেন্ড করেনি। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, এটা কাজ করে।

অভিযোগ উঠেছে, প্লাজমার ওভার ইউজ হচ্ছে দেশে, যা কিনা দীর্ঘমেয়াদে গিয়ে কোনো মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে কোনো অপশন হাতে নেই এমন রোগীকে প্লাজমা দিয়ে দেখা যেতে পারে। একে বলা হয় ‘কমপেসনেট গ্রাউন্ড বা রিজন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. রিদওয়ানুর রহমান বলেন, দুই রকমের অ্যান্টিবডি তৈরি হয় শরীরে। প্লাজমা দিতে হবে করোনা থেকে সেরে ওঠার চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর। তবে এর সঙ্গে আরো অনেক বিষয় জড়িত। যদি সব ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করে না দেখা হয়, তাহলে এতে ‘এক্সপেকটেড বেনিফিট’ পাওয়ার সুযোগ নেই। আর এজন্য আমাদের দেশে বাইন্ডিং অ্যান্টিবডির ওপর নির্ভর করে যে প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হচ্ছে, এতে রোগীর কোনো উপকার নাও হতে পারে। এমনকি এটা তার জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। তার মতে, এখন ক্ষতিটা বোঝা না গেলেও হয়তো এক বছর  কিংবা আরো বেশি হলে পাঁচ বছর পর বোঝা যাবে। তিনি বলেন, আর এসব কারণেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রিকমেন্ড করতে পারছে না। তাই এটা একটা ‘ডাউটফুল’ বিষয়। একে কোনোভাবেই ওভার ইউজ করা যাবে না, একে রেস্ট্রিকটেড ইউজ করতে হবে, গাইডলাইন রিকমেন্ডেড হতে হবে। অধ্যাপক রিদওয়ানুর বলেন, দুনিয়ার কোথাও রেনডমলি প্লাজমা ব্যবহার হচ্ছে না। কারণ এটা রোগীকে ভালো করবে নিশ্চয়তা নেই। আর যদি নিশ্চয়তা থাকত যুক্তরাষ্ট্রে দুই লাখ মানুষ মারা যেত না।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ খুব সক্রিয়। একইসঙ্গে যারা করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন, তারা অনেকেই প্লাজমা দিতে আগ্রহী। ফেসবুকে প্লাজমা দেয়ার বিষয়ে অনেক গ্রুপ হয়েছে। দেশের বড় বড় বেসরকারি করপোরেট হাসপাতাল থেকে যখন প্লাজমার জন্য ডিমান্ড আসে, তখন ফেসবুকের সেসব পেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্লাজমা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের মাইল্ড সিম্পটম থাকে তাদের শরীরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবডি হয় না এবং হলেও পরিমাণ খুব কম, যেটা দিয়ে আসলে আরেকজনের কোনো উপকারের সম্ভাবনা থাকে না। যে কারণে যারা মডারেট টু সিভিয়ার রয়েছেন, তাদেরকে দেখে নিতে হয় যে অ্যান্টিবডি কতটুকু রয়েছে। কিন্তু সেটা না করে প্লাজমা দেওয়ার বিধান কোথাও নেই।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, দেশের বড় বেসরকারি হাসপাতাল থেকে কেবল চিকিৎসকরা নিজেদের পরিবার এবং ভিআইপির যদি প্রয়োজন হয় তখন তার কাছে প্লাজমার জন্য জানান, কিন্তু কোনো সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। নিজেদের জন্য যখন দরকার হচ্ছে তখন যেসব জায়গায় অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্লাজমা দেওয়া হচ্ছে কিন্তু সাধারণ রোগীদের দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোয়ালিটি এসব হাসপাতালে মেইনটেইন হচ্ছে না। আর অ্যান্টিবডি যখন দেখা হয় না, তখন সেটা নরমাল প্লাজমা হয়ে যায়, এটা কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না যে এটা কোভিড রিকভার্ড প্লাজমা। আমরা প্রায়ই নন-কোভিড প্লাজমা নিয়ে আসা রোগীর স্বজনদের পাই।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুই ব্যাগ প্লাজমা দেওয়ারও দরকার হয় না; কিন্তু হাসপাতাল থেকে পাঁচ ব্যাগ প্লাজমা দিচ্ছেন- এর আদৌ কোনো ভিত্তি নেই, সম্পূর্ণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে। একেক ব্যাগ প্লাজমার দাম নেওয়া হচ্ছে অন্তত ২০ হাজার টাকা। পাঁচ ব্যাগ প্লাজমা থেকে নিদেনপক্ষে এক লাখ টাকা ব্যবসার সুযোগ রয়েছে। অথচ দুই ব্যাগের বেশি প্লাজমা সারা বিশ্বে কোথাও ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই এটা বাংলাদেশের কোভিডবিষয়ক গাইডলাইনেও থাকা উচিত।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, অ্যান্টিবডি টেস্ট না করে প্লাজমা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া এক্ষেত্রে শুধু অ্যান্টিবডি আছে কি না, সেটা দেখলে হবে না, কী পরিমাণ আছে সেটাও দেখতে হবে। শরীরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি তৈরি না হলে প্লাজমা দিয়েও ফল পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads