• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ প্রশাসন

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ঢেলে সাজানো হচ্ছে পুলিশ প্রশাসন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ অক্টোবর ২০২০

কর্মরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন অপরাধের কারণে বিগত ১০ বছরে প্রায় সোয়া লাখ পুলিশের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সদস্য শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। এত শাস্তির মধ্যেও পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমেনি। সর্বশেষ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড পুলিশের অপরাধ প্রবৃত্তি ও নৈতিক স্খলনের বিষয়টিকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১০ বছরে (২০১০-২০১৯) বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায় সোয়া লক্ষাধিক পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালে ১১,৬৮৪ জন, ২০১১ সালে ১৩,৭১১ জন, ২০১২ সালে ১৩,১৮০ জন, ২০১৩ সালে ১৪,১৩৬ জন, ২০১৪ সালে ১৫,৩৭৭ জন, ২০১৫ সালে ১০,০৩৪ জন, ২০১৬ সালে ১৩,৫৮৬ জন, ২০১৭ সালে ১২,৮৫৮ জন, ২০১৮ সালে ১৩,৬১৪ জন এবং ২০১৯ সালে ১২,৩২৫ জন পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা ছাড়াও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছেন। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের গুরুদণ্ড ও লঘুদণ্ড দুটোই দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, গুরুদণ্ডের আওতায় অনেককে চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে। এর বাইরে অনেক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে আদালতে মামলাও হয়েছে। এতকিছুর পরও পুলিশে অপরাধপ্রবণতা কমেনি, বরং বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক সেবন, মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা, উৎকোচ গ্রহণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চর্চা পুলিশে নতুন কিছু নয়। এসব অপরাধের সঙ্গে পুলিশ কমবেশি জড়িত ছিল। যে কারণে বিভিন্ন সময় পুলিশকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও বিদ্যমান সমাজে। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিন, ১৯৯৮ সালে ঢাকার ডিবি হেফাজতে কলেজছাত্র রুবেল, ১৯৯৯ সালে পুলিশ সোর্স জালাল, ২০১১ সালে কাফরুলে কলেজছাত্র মোমিন, ২০২০ সালে ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত এবং সাবেক মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশের সংশ্লিষ্টতার যে অভিযোগ, তা পুলিশের ইতিহাসে কালো একটি অধ্যায় বলে অনেকেই মনে করেন।

পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়াটা কেবল মাঠপর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পুলিশের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত কিছু কর্মকর্তাও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন। ডিআইজি মিজানের নারী কেলেঙ্কারি, অঢেল সম্পদ আহরণের ঘটনা কে না জানে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে দাপট দেখিয়ে অপকর্মগুলো করেছেন তিনি। দুদক কর্মকর্তা বাসিরকে ঘুষ দিতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন নিজেই।

কলেজছাত্র মোমিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মতিঝিল থানার সাবেক ওসি রফিকুল ইসলাম। বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়। মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাসে ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম। কক্সবাজারের টেকনাফে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ওসি প্রদীপসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য।

সম্প্রতি পুলিশের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ ওঠায় ঢাকা মহানগর পুলিশ মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে পুলিশ সদস্যদের ‘ডোপ টেস্ট’ করিয়েছে। এতে ২৬ জনের রিপোর্ট পজিটিভ হওয়ায় তাদের চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। এসব ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহ পুলিশের ভাবমূর্তিকে অনেকটাই ক্ষুণ্ন করেছে।

পুলিশের ব্যাপারে নাগরিকের অভিযোগ শোনার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে খোলা হয়েছে আইজিপি কমপ্লেইন্টস সেল। প্রতিদিন এই সেলে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি অভিযোগ জমা পড়ছে। অভিযোগের অধিকাংশই পুলিশের বিরুদ্ধে। ঘুষ, হয়রানি সংক্রান্ত। এই আইজিপি কমপ্লেইন্টস সেল নিয়ে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন বেঞ্চ একটি মামলার সুবাদে অভিমত দেন যে, সেলকে কার্যকর ও গতিশীল করতে হবে। সেলে পেশ করা জনগণের অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইজিপি কমপ্লেইন্টস সেলে প্রতি মাসে গড়ে তিন শতাধিক অভিযোগ জমা হচ্ছে। সেলের ই-মেইল, মোবাইল ফোন ও সরাসরি অভিযোগগুলো আসছে।

অপরাধের সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পুলিশের সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ কোন জায়গায় নেই? দেশের সবখানেই কমবেশি অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। অপরাধের সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। তবে এটাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সে জন্য প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। পুলিশ অপরাধ করলে যে শাস্তি দেওয়া হয়, তা অন্য কোনো বিভাগে দৃশ্যমান হয় না। পাশাপাশি পুলিশে মোটিভেশন কার্যক্রমকে জোরালো করা প্রয়োজন। তাহলেই পুলিশের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে।

কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু পুলিশ কর্মকর্তা নিজেকে অনেক বড় কিছুই ভেবে থাকেন। এর ফলে সিনহার মতো একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। নিঃসন্দেহে এসব ঘটনা পুলিশের ইমেজ ক্ষুণ্ন করছে। সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদের মতে, এটা ব্যক্তির দায়, বাহিনীর নয়। একজন পুলিশ অপরাধ করলে বাহিনী তার দায় নিতে পারে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads