• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বছরে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ ট্রান্সফ্যাট

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৪ অক্টোবর ২০২০

উচ্চমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। দেশে বছরে অন্তত ১২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ উচ্চমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ। তাই খাবারে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা সহনীয় মাত্রায় রাখতে দ্রত নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকরের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি রাজধানীর বিএমএ ভবনের সামনে থেকে তেলে ভাজা খাবার খাচ্ছিলেন আকরাম হোসেন (ছদ্মনাম)। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় দুপুরে হোটেলে খাওয়ার সামর্থ্য হয় না। তাই প্রতিদিনই ফুটপাতের ভাজা-পোড়া খাবার খান। তিনি বলেন, খাবারটা যতই ক্ষতিকর হোক না কেন অল্প টাকায় ক্ষুধা তো নিবারণ হচ্ছে। আকরাম হোসেনের মতো প্রতিদিন দুপুরে কিংবা বিকেলে ক্ষুধা নিবারণে ফুটপাতের তেলে ভাজা এমন খাবার খাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এক তেলে বার বার ভাজায় এসব খাবারে উচ্চমাত্রার ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শুধু ফুটপাতের খাবারেই নয়, হোটেল-রেস্তোরাঁর ভাজা খাবার, বিভিন্ন ফাস্টফুড ও বেকারি পণ্যে স্বাদ, ঘ্রাণ ও স্থায়িত্ব বাড়াতে ব্যবহূত হয় বনস্পতি, যা ট্রান্সফ্যাটের অন্যতম উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন মানুষের দৈনিক ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত মোট খাদ্যশক্তির ১ শতাংশের কম, অর্থাৎ দৈনিক ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটে তা হতে হবে ২.২ গ্রামের চেয়েও কম।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমাত্রার ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ, হূদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হূদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ঢাকার পিএইচও নমুনার ৯২ শতাংশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। সম্প্রতি প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত উপস্থিতি পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। এছাড়া ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুটের নমুনায় ৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পেয়েছেন তারা।

খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে দেশে এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালা হয়নি। তবে এ লক্ষ্যে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা বেশ কয়েকটি সভাও করেছে। কমিটির প্রধান, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বলেন, আশা করছি সর্বোচ্চ ৬ মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ট্রান্সফ্যাট রেগুলেট করার খসড়া নীতিমালা করতে পারব। রেগুলেশনের খসড়া চূড়ান্ত হলে বিএসটিআই সে অনুযায়ী মান তৈরি করতে সক্ষম হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে অনুযায়ী ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি গ্রহণ না করায় এখনো ১৪৩টি দেশের ৮৮৬ মিলিয়ন মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন। উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশসমূহ ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম পন্থা গ্রহণ করলেও নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যম আয়ের কোনো দেশই এখন পর্যন্ত এ ধরনের নীতিমালা গ্রহণ করতে পারেনি। এ পর্যন্ত মোট ৩২টি দেশ ট্রান্সফ্যাট সীমা কার্যকর করেছে। ২৬টি দেশ ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সর্বোত্তম নীতি পাস করেছে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে কার্যকর হবে। 

ডব্লিউএইচওর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ট্রান্সফ্যাটজনিত হূদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং প্রতি বছর হূদরোগে দেশে যত মানুষ মারা যায় তার ৪.৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্সফ্যাট। হূদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায় ২ লক্ষ ৭৭ হাজার ৯৯২ জন। সে হিসেবে ১২ হাজার ২৬০ জনের মৃত্যুর জন্য ট্রান্সফ্যাট দায়ী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি ৭৯ লক্ষ মানুষ হূদরোগে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। দেশের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়ংশে কমিয়ে আনা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (লক্ষ্য ৩.৪) অর্জন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। সুতরাং হূদরোগ প্রতিরোধসহ জনস্বাস্থ্যের কার্যকর উন্নয়নের জন্য ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের কোনো বিকল্প নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল বৃদ্ধি করে এবং এইচডিএল কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। এইচডিএল কোলেস্টেরল রক্তনালি থেকে খারাপ কোলেস্টেরল সরিয়ে দেয়। কিন্তু ট্রান্সফ্যাটের কারণে এইচডিএল কমে যায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। বেড়ে যায় হূদরোগের ঝুঁকি। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে উচ্চহারে হূদরোগ, হূদরোগজনিত মৃত্যু, স্মৃতিভ্রংশ এবং স্বল্প স্মৃতিহানি জাতীয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ব্যাপকভাবে সম্পর্কযুক্ত।

ট্রান্সফ্যাট দুই ধরনের- প্রাকৃতিক ও শিল্পোৎপাদিত। প্রাকৃতিকগুলো খুব একটা ক্ষতি করে না। কিন্তু শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট মারাত্মক ক্ষতিকর। গবাদি পশু-প্রাণীর অন্ত্রে এটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়, যার ফলে গরু-ছাগলের মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার, যেমন ঘি, মাখন ইত্যাদিতে স্বল্পমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যায়। অন্যদিকে আংশিক জারিত তেল অর্থাৎ ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন করা হলে তেল তরল অবস্থা থেকে মাখনের মতো অর্ধ-কঠিন মারজারিন বা কঠিন ডালডা বা বনস্পতি উৎপন্ন হয়, এ প্রক্রিয়ায় ট্রান্সফ্যাটও উৎপন্ন হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রান্সফ্যাটের ক্ষতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি নীতিনির্ধারক, উৎপাদক, সরবরাহকারীকে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের পরিবর্তে স্বাস্থ্যসম্মত তেল/চর্বির ব্যবহারের বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। আইন প্রণয়ন করে খাদ্যে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশের নিচে নির্ধারণসহ পিএইচও’র উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। খাদ্যে ট্র্যান্সফ্যাটের পরিমাণ এবং মানুষের ট্র্যান্সফ্যাট গ্রহণের মাত্রায় পরিবর্তন হচ্ছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads