• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বেড়ে যাচ্ছে জমির মূল্য ও নিবন্ধন ব্যয়

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

বেড়ে যাচ্ছে জমির মূল্য ও নিবন্ধন ব্যয়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৯ নভেম্বর ২০২০

১০ লাখ টাকার জমি ১৫ লাখ এবং এক কোটি টাকার জমি দেড় কোটি টাকা। এভাবে নির্ধারিত জমির মূল্য ধরে জমি নিবন্ধন করতে হবে। এতে নিবন্ধন ব্যয়ও বেড়ে যাবে ৫০ ভাগ। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে অতিরিক্ত এ টাকা গুনতে হবে জমির ক্রেতাদের।

বাস্তবে জমির দাম বৃদ্ধি না পেলেও পদ্ধতিগত কারণ আর আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে জমির ক্রেতাদের পকেট থেকে খসে যাবে অতিরিক্ত এ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন অধিদপ্তরের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে দীর্ঘদিন ধরে দেশে জমির মূল্য নিয়ে অরাজকতা চলছে। নিবন্ধিত দলিলে উল্লেখ করা মূল্য গড় করে দুই বছর পরপর মৌজাওয়ারি জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। জেলা রেজিস্ট্রার থাকেন নিজ নিজ জেলার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সভাপতি। কিন্তু গত চার বছর ধরে জমির মূল্য নির্ধারণ কমিটিগুলো ছিল নিষ্ক্রিয়।

জমির মূল্য নির্ধারণ আইনের সূচনা হয় ২০০২ সালের ১ জুলাই। তখন নির্ধারিত মূল্যে জমি নিবন্ধন শুরু হলেও এ আইনের দুর্বলতার কারণে বাস্তবে না বাড়লেও কাগজে-কলমে মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। জমির দামের এ ভৌতিক বৃদ্ধির ফলে ক্রেতাদের কাছে তা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দেয়। তখন বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। একাধিক সাব-রেজিস্ট্রার জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কিংবা কালো টাকা সাদা করার জন্য জমির মূল্য কয়েক গুণ দেখিয়ে বিভিন্ন স্থানে জমির দলিল নিবন্ধন শুরু হয়। অনেক স্থানে অধিগ্রহণকৃত জমির অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য নিবন্ধনকৃত দলিলে জমির বেশি মূল্য দেখানো হয়। ফলে এসব স্থানে জমির গড় মূল্যও হয়ে দাঁড়ায় আকাশচুম্বী। এ কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে নিবন্ধন খরচ বেশি হয়ে যায়। ফলে সেখানে সাফকবলা দলিল নিবন্ধন কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এ বিষয়গুলো অনুধাবন করে ২০১৭ সালে একটি পরিপত্র জারি করে জমির বাজারমূল্য নির্ধারণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, একটি উচ্চতর বিশেষ কমিটি গঠন করে এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, যার ওপর ভিত্তি করে নতুন করে বাস্তবসম্মত জমির মূল্য নির্ধারণ করা হবে।

কিন্তু দীর্ঘ চার বছরেও কোনো কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। ফলে সমস্যাগুলো ডালপালা গজিয়ে বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এসব সমস্যা নিয়েই বর্তমানে প্রতিটি জেলা কমিটি আগের মতো আবার জমির সরকারি মূল্য নির্ধারণের কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী ও রংপুর জেলা রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এর সত্যতা জানা গেছে। এতে আগের চেয়ে বর্তমানে জমির মূল্য ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করছেন জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব রেজিস্ট্রাররা। নোয়াখালী জেলা রেজিস্ট্রার আবদুল খালেক জানান, তিনি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে সাব-রেজিস্ট্রার থাকার সময় চার-পাঁচটি মৌজার জমির সরকারি মূল্য ময়মনসিংহ শহরের জমির মূল্যের চেয়ে বেশি ছিল। দুই বছরে চাকরিকালীন সেসব মৌজায় একটিও সাব-কবলা দলিল নিবন্ধন হয়নি। বর্তমানে নোয়াখালী জেলা রেজিস্ট্রার হিসাবে বদলি হয়ে এসে আবদুল খালেক দেখেন, সেনবাগ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের আওতাধীন একটি মৌজায় ‘ভিটি’ জমির মূল্যের চেয়ে ‘নাল’ জমির মূল্য বেশি। কিন্তু প্রচলিত আইন বা নিয়মে এ ধরনের বড় ত্রুটির ওপর নির্ভর করেই জমির মূল্য নির্ধারণ করতে হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, খোদ ঢাকা শহরের বেশ কিছু মৌজায় এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে আবদুল্লাহপুর মৌজার ক্ষেত্রে ঘটে নজিরবিহীন ঘটনা। মতিঝিলের চেয়ে বেশি মূল্য ধরা হয় তুরাগ নদের তীরবর্তী নিচু জমির। এ কারণে এ মৌজার সাবকবলা দলিল নিবন্ধন বন্ধ হয়ে যায়। উত্তরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা যায়, আবদুল্লাপুর মৌজায় সাফকবলা দলিল রেজিস্ট্রি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাঠি পৌর অঞ্চলের ভিটি জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬০ লাখ টাকা শতাংশ, যা ঢাকার অভিজাত এলাকার জমির মূল্যের চেয়েও বেশি। এর ফলে নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মূল্য পুনর্নির্ধারণ হলেও তা এখন বাস্তবের দামের চেয়ে অনেক বেশি। রংপুরের জেলা রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম প্রামাণিক বলেন, ‘জমি নিবন্ধন হওয়ার পর তার ভিত্তিতে জমির গড় মূল্য নির্ধারণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ কমিটি অসহায়। আইনের কাছে তাদের হাত-পা বাঁধা। অসংগতি ধরা পড়ার পরও তা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই।’

একাধিক সাব-রেজিস্ট্রার জানান, সম্পত্তির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা ২০১০-এর ৫ ধারার ৫ ও ৬ উপধারায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বেশি কিংবা কম ধরা হলে তা পুনর্নির্ধারণের নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। আবেদনপত্র বছরের পর বছর ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকে। ঢাকা সদর দলিল লেখক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে জমিজমার দাম খুবই নিম্নমুখী। অথচ সরকার কাগজে-কলমে জমির মূল্য বৃদ্ধি করেই যাচ্ছে। এতে আবাসন ক্ষেত্রে বিপর্যয় আরো ভয়াবহ হবে।’

ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে জমির মূল্য নির্ধারণের প্রভাব ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। একদিকে জমিজমার দাম কমছে, অপরদিকে নিবন্ধন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। জানুয়ারিতে তা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে সরকারি রাজস্বের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন। দলিল নিবন্ধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার, কর্মকর্তা দলিল লেখক জমির মূল্য বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেন।

বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির সভাপতি নূরে আলম ভূঞা বলেন ‘এভাবে চলতে থাকলে অনেক ক্ষেত্রে জমির মূল্যের চেয়ে নিবন্ধন খরচ বেশি হয়ে যাবে। এতে সাফকবলা দলিলের পরিবর্তে হেবা, দান কিংবা আমমোক্তারনামা দলিল নিবন্ধনে মানুষ বেশি উৎসাহিত হবেন।’ জমির মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নানা সমস্যা নিয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল আব রেজিস্ট্রেশন (আইজিআর) সিনিয়র জেলা জজ শহীদুল হক ঝিনুক বলেন ‘আইন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে জমির সরকারি মূল্যের চেয়ে যেমন অতিরিক্ত মূল্যের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি কম মূল্যের কথাও জানা যাচ্ছে। বিষয়গুলো সমাধানের জন্য আমরা কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘এবার গড় মূল্য নির্ধারণ হলে জমির মূল্য কী পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে সেটা স্পষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। আগে নির্ধারণ হোক। যদি অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় তাহলে ঊর্ধ্বতন মহলের পরামর্শ গ্রহণ করা হবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads