• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

কমিশন বাণিজ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরাই

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২২ নভেম্বর ২০২০

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দালালদের খপ্পরে পড়ে সুচিকিৎসার বদলে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। নিরাপত্তাকর্মী থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক পর্যন্ত দালালচক্রে জড়িত বলে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপন চিকিৎসার নামে দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় দালালচক্র ও কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। 

অভিযোগ উঠেছে ভুঁইফোঁড় মাইন্ড এইড হাসপাতালে আনিসুল করিমকে চিকিৎসার জন্য পাঠান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ডা: আব্দুল্লাহ আল মামুন। পুলিশের তথ্য বলছে, তিনি প্রায়ই কমিশনের লোভে এ হাসপাতালে রোগী পাঠাতেন। শুধু ড: মামুন নয়, রোগীদের নিজেদের পছন্দের হাসপাতালে পাঠিয়ে টাকা কামানোর পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় প্যাথলজি টেস্ট করিয়ে ডাক্তাররা সেখান থেকে কমিশন নেন বলে জানা গেছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান-নিটোর (পঙ্গু হাসপাতাল), শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, টিবি হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট এবং হাসপাতালে দালালচক্র সক্রিয় রয়েছে।

এমনিতেই ঢাকা মেডিকেলে সারা বছরই রোগীরদের ভিড় লেগেই থাকে। ঢাকার বাইরে থেকেও অসংখ্য রোগী এখানে চিকিৎসার জন্য আসেন। কিন্তু এর বাইরেও একশ্রেণির অসাধু চিকিৎসক দালালচক্রের কাছে বিভিন্ন জেলা হাসাপাতাল থেকে ঢাকায় রোগী পাঠায়। অ্যাম্বুলেন্স চালক থেকে শুরু করে চিকিসা সেবা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পদের লোক এর সঙ্গে জড়িত। ফোনে ফোনে কমিশনে সরকারি হাসপাতালের সামনে থেকে রোগী ভাগানোর অভিযোগও রয়েছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢামেকের নাক-কান-গলা বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালে সৎ চিকিৎসকের সংখ্যাই বেশি। অধিকাংশই সততার সঙ্গে সেবা দেন। কিন্তু কিছু চিকিৎসক আছেন যাদের সারা দেশে নেটওয়ার্ক আছে। তারা ঢাকার বিভিন্ন মাঝারি বা বড় ক্লিনিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেন। আবার কোনো কোনোটিতে তাদের সরাসরি মালিকানাও রয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে যখন কোনো রোগী আসে তখন এ চিকিৎসকরা তাদের ঢামেকে সেবা নেই-এটা বোঝানোর চেষ্টা করেন। অনেক সময় তাদের এজেন্টরা এ কাজটি করেন। পরে তারা গিয়ে বাইরের ক্লিনিকে সেবা দেন।

ঢামেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্যের সত্যতাও পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাকরিজীবী নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসেছেন স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে। রোগীর জরায়ুতে টিউমার। স্থানীয় চিকিৎসকরা রোগীর অবস্থা জটিল পর্যায়ে গেছে বলে জানানোয় তিনি ঢামেকে আসেন। এখানে থেকে তাদের মহাখালির ক্যানসার হাসপাতালে পাঠানো হয় পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য।  পরীক্ষায় টিউমারে ক্যানসারের কোনো জীবাণু পাওয়া না গেলেও অপারেশন করতে হবে বলে ডাক্তারা জানান। ঢামেকের একজন চিকিৎসক তাদের জানান, এখানে এ ধরনের অপারেশন হয় না। তিনি  রাজধানীর কচুক্ষেতের একটি বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশনের জন্য ভর্তি হতে বলেন। সেখানে অপারেশনের পরে তারা ৫ দিন ছিলেন। তখনও রোগী সুস্থ হননি। কিন্তু খরচ আর কুলিয়ে উঠতে না পেরে যে চিকিৎসক কচুক্ষেতে অপারেশন করেছিলেন তার অধীনেই রোগীকে আবারো ঢামেকে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসকের পরিচয় জানতে চাইলে ‘রোগীর অসুবিধা হতে পারে’ এমন শঙ্কায় তিনি তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢামেকের নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব পালন করা এক আনসার সদস্য বলেন,  এখানে এসে জীবনের নতুন শিক্ষা হয়েছে। গত এক বছর ধরে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি।  এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী আসছে। রোগী যে অ্যাম্বুলেন্সে আসে সেখান থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত সবখানে দালাল ছড়িয়ে আছে। তারা রোগীকে বাইরের ক্লিনিকে কম টাকায় ভালো সেবার অফার দেয়। যে রোগী রাজি হয়, তাকে পাঠানো হয় চুক্তিভিত্তিক হাসপাতালে। রোগীর যা বিল হয় তা থেকে যিনি রোগী পাঠান তিনি কমিশন পান।

বর্তমানে গাইনী বিভাগে কর্মরত একজন সিনিয়র নার্স বলেন, এর আগের পরিচালক (ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন) দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন বেশকিছু বহিরাগতকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। ফের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। অনেককে বদলি করা হয়েছিল। এরপর দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমে। এখন আর হাসপাতালের ভেতরে কেউ রোগীদের সরাসরি অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য টানাটানি করে না। তবে বাইরেই যাদের বোঝানো সম্ভব হয়, তাদেরই নিয়ে যাওয়া হয় প্রাইভেট ক্লিনিকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও কমিশন বাণিজ্যির ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করেছে সাতক্ষীরা  থেকে চিকিৎসা নিতে আসা এক ব্যক্তি। কোমরে ও মেরুদণ্ডের ব্যথার জন্য চিকিৎসা নিতে আসা এই ব্যক্তি জানান, মাহবুব নামের এক আনসার সদস্য ভালো ডাক্তারের খোঁজ দেবেন বলে তার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়েছেন। অথচ, দুইদিন ধরে হাসপাতালে ঘুরলেও ভালো চিকিৎসা পাচ্ছেন না। 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা: ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট হাসপাতালের রেজিস্ট্রার গ্রেপ্তার হয়েছেন শুনেছি। এ বিষয়ে আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। প্রতিবেদনের আলোকে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে কমিশন বাণিজ্য বন্ধের বিষয়েও শিগগিরই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads