• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

রোহিঙ্গা সংকট

ভারত-চীনের অবস্থান নিয়ে বিচলিত নয় বাংলাদেশ

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৪ নভেম্বর ২০২০

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবাধিকার রক্ষা আর তাদের নিজ দেশে ফেরানো নিয়ে ভারত ও চীনের ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ অবস্থান নিয়ে বিচলিত নয় বাংলাদেশ। এ নিয়ে  জাতিসংঘে চতুর্থ দফায় গৃহীত প্রস্তাবে নীরব থাকায় এই ইস্যুতে চীন ও ভারতের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। গত বুধবার গৃহীত ওই প্রস্তাবে বেইজিংয়ের অবস্থান ঢাকার বিপক্ষে ছিল। আর কোনো পক্ষাবলম্বন না করে মধ্যপন্থায় ছিল দিল্লি।

বাংলাদেশের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত দেশ দুটির এই অবস্থান ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। দেশ দুটির অবস্থান মিয়ানমারের পক্ষে যাওয়ায় এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সবচেয়ে বড় নিয়ামক রাষ্ট্র চীন-ভারতের জাতিসংঘে গৃহীত রেজুলেশনে সমর্থন না করার বিষয়টি নিয়ে বিচলিত নন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। বেইজিং-নয়াদিল্লি রেজুলেশনে বিপক্ষে এবং মধ্যমপন্থা অবলম্বন ইস্যুতে এক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা টাইমসকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এগুলো ভালোমন্দ। আমরা এটাতে বিচলিত নই। আমরা এগুলো ইতিবাচক হিসেবেই নিচ্ছি।

নয়াদিল্লির ঢাকাকে সমর্থন না দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারত আগে আমাদের বলেছে, তারা যদি এক পক্ষ হয়ে যায় তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ‘দে কেন নট বি গুড নেগোসিয়েটর’। সেজন্য তারা নিউট্রল অবস্থানে থাকছে। এতে নাকি তাদের সুবিধা হয়।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশ নাকি মিয়ানমারকে সমর্থন করে-এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে ভারতের পক্ষ থেকে বারবার বাংলাদেশকে সমর্থনের বিষয়ে বলা হলেও ভেতরে ভেতরে দেশটির মিয়ানমারকে সমর্থনের বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে।

মিয়ানমারের রাখাইনে নির্বিচারে হত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়নের শিকার হয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেয়। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে আসা বিপুল শরণার্থীকে ফেরত পাঠানো নিয়ে এর আগেও তিনটি প্রস্তাব পাস হয় জাতিসংঘে। তবে ওই অর্থে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তা কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।

সবশেষ গত বুধবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবাধিকার রক্ষা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে সাধারণ পরিষদে চতুর্থবারের মতো প্রস্তাব গৃহীত হয়। আগের তিন প্রস্তাবের মতো এবারো বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র চীন-ভারতকে একই ভূমিকায় দেখা গেছে। অর্থাৎ ঢাকার বিপক্ষে সমর্থন দিয়েছে বেইজিং। আর নয়াদিল্লি রেজুলেশনের পক্ষে-বিপক্ষে না গিয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে।

মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কনসাল্টেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকের পর দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে ঢাকার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব খাটানোর জন্য অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

এরপরই এক ঝটিকা সফরে মিয়ানমার যান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও সেনাপ্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে। সেই সফরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং সে দেশের সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ অং মিন লেইং-এর সঙ্গে বৈঠক করেন।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান তাদের মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানান। চীনের মিয়ানমারকে সমর্থনের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছেন মোমেন। এর ব্যাখায় মোমেন বলছেন, ‘চীন আমাদের বিপক্ষে সমর্থন দিলেও চীনের বেসিক এলিমেন্ট হলো এসব রেজুলেশন করে সমস্যার সমাধান হবে না। তারা যেহেতু আমাদের পক্ষে রেজুলেশনের বিপক্ষে দিয়েছে, এখন আমরা তাদের আরো জোর দিয়ে বলতে পারব তুমি তো মিয়ানমারের পক্ষে ভোট দিয়েছ।’

সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে চীনকে আশ্বস্ত করেছে মিয়ানমার। এ বিষয়ে মিয়ানমারের নির্বাচনের পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে চীন। শুধু তাই নয়, বৈঠকের জন্য ঢাকাকে প্রস্তুতির তাগিদ দিয়েছে মিয়ানমারের বন্ধু রাষ্ট্রটি। তবে নির্বাচন শেষ হওয়ার পর কয়েকদিন কেটে গেলেও এখনো ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে কোনো তারিখ নির্ধারিত হয়নি।

সবশেষ গত বছরের শেষের দিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের বিভিন্ন উদ্যোগ আশার আলো দেখা দিলেও তাতে কোনো ফল মেলেনি। এরই মধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে চীনের সঙ্গে আরো জোরালো কূটনৈতিক বাড়ানোর সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় হানা দেয় চীনের উহানে শুরু হওয়া নতুন মহামারী করোনাভাইরাস।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে গত বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে রেজুলেশনটি উত্থাপন করে যাতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ১০৪টি দেশ। রেজুলেশনটির পক্ষে ভোট দেয় ১৩২টি দেশ, বিপক্ষে ৯টি আর ভোটদানে বিরত থাকে ৩১টি দেশ।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসির সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আন্তঃআঞ্চলিক জোটের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পায় রেজুলেশনটি।

তবে প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়-মিয়ানমার, চীন, রাশিয়া, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, জিম্বাবুয়ে ও লাওস। অন্যদিকে ভোট না দিয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে-বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভেনেজুয়েলা। রেজুলেশনের পক্ষে সমর্থন করা দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রেজুলেশনের পক্ষে বা বাংলাদেশকে চীন ও ভারত সমর্থন করবে না এটাই হওয়ার ছিল। এর কারণ হিসেবে তাদের ভাষ্য, স্বার্থবিবেচনায় এ দুই দেশ যতই বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করুক মূলত মিয়ানমারের পক্ষেই তাদের অবস্থান।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন বলছে, রেজুলেশনটি মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ অন্যান্য সহিংসতার শিকার নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিপুল সংখ্যক জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও অকুণ্ঠ সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দিন খান বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন-ভারতের এ অবস্থানতো খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করাটা একটা মৌখিক পর্যায়ের। যদি স্বার্থ দিয়ে বিবেচনা করা হয়, মিয়ানমারের সঙ্গে ভারত ও চীনের যে সম্পর্ক সেটার গুরত্ব তাদের কাছে অনেক বেশি। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওদের জন্য জরুরি ইস্যু হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে এলেই মিয়ানমারের পক্ষে থাকা। স্বার্থের দিক থেকে দুই দেশই মিয়ানমারকে বেশি গুরত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়টাই তাদের কাছে বড়, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান নয়-যোগ করেন এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের পুলিশি চৌকিতে কথিত হামলার ধুয়ো তুলে সেনা অভিযান শুরুর পর প্রাণে বাঁচতে কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরো চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজো শুরু হয়নি। গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads