• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

বেগমপাড়ার মালিক কারা

কানাডায় ২৮ বাংলাদেশির বাড়ি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৭ নভেম্বর ২০২০

পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে বিশ্বের বড় বড় নেতা ও ব্যবসায়ীর নাম উঠে আসায় ব্যাপক হইচই পড়ে যায়। সে সময় বিভিন্ন বাংলাদেশি নাগরিকের নামও তালিকায় উঠে আসে। কিন্তু  কানাডার বেগমপাড়ায় অর্থ পাচারের সঙ্গে কারা জড়িত সে সম্পর্কে এ পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, যদিও বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনা চলছে।

বেগমপাড়ায় বাংলাদেশিদের বেশ কিছু বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে বলে গত কয়েকদিন ধরে মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বেগমপাড়ায় ২৮ বাংলাদেশির বাড়ির খোঁজ পেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। যার মধ্যে বেশিরভাগেরই মালিক সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা। এসব বাড়ির মালিক কারা সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বশেষ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেগমপাড়ায় অর্থ বিনিয়োগকারীদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে বলে জানা গেছে।  

কানাডার ‘বেগমপাড়ায়’ অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে কয়েক বছর ধরেই। সেখানে কয়েকজন বাংলাদেশি এ নিয়ে আন্দোলনও করেছেন। তবে কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাস এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কাজ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে গত ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের পর বেগমপাড়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে।

ঐদিন মন্ত্রী বলেন, বেগমপাড়া বিষয়ে খবর নিয়েছি, প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনীতিবিদ মাত্র চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ীও আছে। বিদেশে যদি কেউ বৈধভাবে টাকা নেয়, তাহলে কোনো আপত্তি নেই। তবে অবৈধভাবে পাচার করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এই কর্মকর্তা কারা, আট দিনেও মেলেনি জবাব। একাধিক মন্ত্রী জানিয়েছেন, তদন্তের নির্দেশ এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। দুদক বলেছে, তারা মাঠে নেমেছে। তবে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, তারা কারা, তার জবাব দিচ্ছেন না কেউ।

এরপর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বেগমপাড়া নিযে তদন্ত হবে; নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে, ব্যবস্থা নেবে তারা; শুরু হচ্ছে অনুসন্ধান। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, তারা কারা, তার কোনো জবাবই মিলছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, নাম তারা জানাবেন না। দুদকের এক কর্মকর্তা বলছেন, আগেভাগে জানালে এটা হবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এখনো কোনো অনুসন্ধান কমিটি হয়নি। তবে অর্থ পাচারে জড়িতদের তালিকা চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়েছে তাদের মানিলন্ডারিং ইউনিট। ওই চিঠিতে বিনিয়োগকারী হিসেবে যারা কানাডায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন তাদেরও তথ্য চাওয়া হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের তালিকা চেয়ে কোনো চিঠি দেয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা দুদক।

তিনি বলেন, আমরা সব সময় এসব নিয়ে কাজ করি। পত্রপত্রিকায় খবর এলে বা কোনো সংস্থা থেকে তথ্য চাওয়া হলে আমরা তখন সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে থাকি। বিষয়টি নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবালের মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, নো কমেন্ট ইজ মাই কমেন্ট। পরে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী তো সকল ব্যাপারেই বলে থাকেন বা বলেছেন। এটা জেনারেল অর্ডার বা ইনস্ট্রাকশন ফ্রম দ্য অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার।

তদন্ত কাজের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে এ কমিশনার বলেন, আমরা কাজ করছি। দেশের মধ্যেই একটা তথ্য নিতে অনেক সময় লাগে। কত এজেন্সি, কত দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা আছে। আর বিদেশে হলে বৈদেশিক আইন, আমাদের আইন, এগুলো অনেক জটিল বিষয়। কাজেই এটা চলমান আছে। এটুকু বলা যাবে। তদন্ত শেষ হতে কত সময় লাগতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা দিতে পারেননি তিনি। বলেন, এগুলো যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব, সে চেষ্টা আমরা করব।

অর্থ পাচারে জড়িতদের পরিচয় জানতে চাইলে মোজাম্মেল বলেন, এখনই নাম বলা সম্ভব নয়। কারণ তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। কেন মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে জানতে চাইলে বলেন, কোনোভাবে এটাকে জাস্টিফাই না করে বলা হলে, এটা তার জন্য অবমাননাকর হবে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এটা হিউম্যান রাইটসের বরখেলাপ হবে। অর্থ পাচারে যাদের নাম এসেছে, দুদকের বিবেচনায় যতক্ষণ তারা অভিযুক্ত বিবেচিত না হবেন, ততক্ষণ তাদের নাম প্রকাশ করা হবে না। 

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের কাছ থেকেও কারো নাম জানা যায়নি। তবে সরকারি কর্মকর্তাদের নাম আসায় তিনি হতাশ। বলেন, স্বভাবগত কারণ আর দেশপ্রেমের অভাবেই এমন কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। প্রতিমন্ত্রী জানালেন, মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং শাখা আছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে সেখানে শুনানি করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে মামলা করা হয় বা দুদককে জানানো হয়। তবে কানাডায় যারা অর্থ পাচার করেছেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রমাণ পেয়েছেন, তাদের বিষয়ে কোনো শুনানি হয়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিং শাখায়।

নামের তালিকা প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কালো তালিকা প্রকাশের দায়িত্ব সংসদের। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যদি নামগুলো চায়, তাহলে তারা করতে পারবে। কিন্তু কালো তালিকা প্রকাশের বিধান মন্ত্রণালয়ের নেই। কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনার বিষয় বেগমপাড়া। কানাডায় অর্থ পাচার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরব হন বাংলাদেশিরা। তাদের একজন শওগাত আলী সাগর বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে এ নিয়ে আন্দোলন করছি। অনেক চেষ্টা করেছি। এটা করতে গিয়ে দূতাবাস আমাদের সাহায্য দূরের কথা, উল্টো আমাদের নিরুৎসাহিত করেছে।

বেগমপাড়া কোনো নির্দিষ্ট এলাকার নাম নয় বা নির্দিষ্ট কোনো এলাকাতেও অবস্থিত নয়। এর বেশিরভাগই টরেন্টো, মন্ট্রিয়ল, অটোয়া শহরে অবস্থিত। মূলত দেশের ধনী ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানরা, যারা বিনিয়োগ ভিসায় কানাডায় অভিবাসী হয়েছেন তাদের এলাকা। স্বামীরা দেশে থেকে অর্থের জোগান দেন, আর স্ত্রীরা সন্তানদের নিয়ে সে টাকায় কানাডায় থাকেন, সন্তানদের লেখাপড়া করান। অভিযোগ উঠেছে, এসব এলাকায় যারা বাড়ি করছেন, তারা প্রত্যেকেই অবৈধভাবে অর্থ পাচার করেছেন। 

এসব এলাকায় স্বামীরা স্থায়ীভাবে থাকেন না, বেড়াতে যান। এজন্য এসব এলাকাকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ডাকেন বেগমপাড়া বলে। হঠাৎ করে বেগমপাড়া আলোচনায় আসার আরেকটি কারণ হলো দেশটির সরকারি সংস্থা দ্য ফিন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার ফর কানাডা (ফিনট্র্যাক) গত এক বছরে তাদের দেশে এক হাজার ৫৮২টি অর্থ পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করেছে। যদিও এ তালিকায় বাংলাদেশি কেউ আছে কি না সে বিষয়ে এখনো কানাডা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।

এ বিষয়ে দুদক সচিব দিলওয়ার বখত বলেন, কানাডার বেগমপাড়ায় সরকারি কর্মকর্তাদের ২৮টি বাড়ির বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। সরকারের কাছে ওই তালিকাও চেয়েছি। তালিকা পাওয়া গেলে কাজ শুরু হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের অর্থ পাচারের বিষয়ে গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দেশের বাইরে অর্থ পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য তদন্ত সংস্থা কাজ করছে।

এদিকে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য চেয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব, দুদক চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত ২২ নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেন। এ রুল বিবেচনায় থাকা অবস্থায় বিদেশে টাকা পাচারকারীদের নাম ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য (মামলাসহ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না) প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, এনবিআর চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে বেগমপাড়ার বিষয়টি আলোচনায় আসার আগেই গত ২২ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের কাছে দুদক কমিশনের মহাপরিচালক (অর্থ পাচার) আ ন ম আল ফিরোজ এক চিঠিতে বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের তালিকা চান। বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব থাকা বাংলাদেশিদের তালিকা প্রসঙ্গে শিরোনামের ওই চিঠি দেওয়া হয়।

এতে বলা হয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও পত্রিকায় প্রকাশিত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মিস-ইনভয়েসিং, হুন্ডি, বাল্ক ক্যাশ ট্রান্সফার ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে থাকে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত তার মূলধন হারানোয় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য যে পরিমাণ দেশীয় বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করতে হলে অর্থ পাচার রোধ করা একান্ত দরকার।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ এদেশে থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগের (ইনভেস্টমেন্ট কোটা) মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নাগরিত্ব নিয়েছেন। চিঠিতে আরো বলা হয়, বহুল আলোচিত পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন বাংলাদেশি নাগরিকের নামও উঠে এসেছে। এ ধারা রোধ করা না গেলে আমাদের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ভবিষ্যতে থমকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে নাগরিকত্ব নেওয়া রোধের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads