• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

অর্থনীতিতে আশাজাগানিয়া ভ্যাকসিন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০২১

করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন করে বিপর্যয়ে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি সচলে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভ্যাকসিন। বছর খানেক আগে শুরু হওয়া করোনা মহামারীর মধ্যে একপর্যায়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা। মানুষের জীবন বাঁচাতে স্থল-জল-আকাশ পথ সবই বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম ধাক্কা খায় আমদানি-রপ্তানি। অর্থনীতির সব রকম সূচক লন্ডভন্ড হয়ে যায়। প্রথম দফার সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হয় করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ। এর ফলে আরো বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দেশের অর্থনীতি।

তবে এমন অন্ধকারে আশার আলো হয়ে দেখা দিতে পারে ভারতের দেওয়া উপহারের ভ্যাকসিন। ওই আলো আরো উজ্জ্বল হয় ৩ কোটি ভ্যাকসিন কিনতে সরকারের চুক্তির পর। ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, দেশে আসা ২০ লাখ ভ্যাকসিনে অর্থনীতির সব অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। চাঙা হবে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম। তবে এ ধরনের বড় প্রত্যাশার আড়ালে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে নানা সন্দেহ, মত-দ্বিমতও আছে।

এ বিষয়ে সার্বিক অবস্থা নিয়ে জানতে কথা হয় কয়েকজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাদেরই একজন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

করোনার ভ্যাকসিন দেশে আসায় কিছুটা হলেও অর্থনীতির চাকা গতিশীল হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আসলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতটুকু হবে, সে বিষয়ে এখনো পরিষ্কার নয় কেউ। এটা নিয়ে অনেকের মাঝে অনেক ধরনের সন্দেহ রয়েছে। তাই ভ্যাকসিন আসলে কী ভূমিকা রাখবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের জন্য আগে থেকেই ইতিবাচক রয়েছে অর্থনীতি। এর কারণ হলো- আমরা অনেক আগেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছি। করোনার প্রকোপ বাড়ায় বিশ্বের অনেক দেশেই জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল। এখনো অনেক দেশেই জরুরি অবস্থা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়নি। মূলত সীমিত সামর্থ্যের কারণেই বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল তখন। এর ফলে অর্থনীতিতে ভালো ফলও পাওয়া গেছে। অর্থনীতির এই গবেষক বলেন, এখন দেশে ভ্যাকসিন এসেছে। এটা ভালো খবর। তবে ভ্যাকসিন আনাটাই পর্যাপ্ত নয়। অর্থনীতিতে এর সুফল পেতে হলে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার। প্রথমত, পর্যাপ্ত পরিমাণে ভ্যাকসিন আনতে হবে। সরকার বলছে, প্রতি মাসে ২৫ লাখ করে ভ্যাকসিন আনা হবে এবং জনগণকে দেওয়া হবে।

এই হিসাবে ১৮ বছরের  ঊর্ধ্বের সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে সময় লাগবে প্রায় ৪ বছর। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত কী অর্থনীতি বসে থাকবে? তবে সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করাও জরুরি। দ্বিতীয়ত, ভ্যাকসিন আসার বহু আগেই মানুষ চ্যালেঞ্জ নিয়ে করোনার প্রকোপের মধ্যেও কাজকর্মে ঢুকে পড়েছে। এতে অধিকাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থও হয়ে গেছেন। অতএব ভ্যাকসিনের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশে অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে সেই তুলনায় কিছুটা কম হওয়ারই কথা। কারণ বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় অর্থনৈতিক কর্মকা্ল বন্ধ রাখেনি। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ, এর প্রতিক্রিয়া এবং কার্যকারিতা নিয়ে নানা কৌতূহল রয়েছে মানুষের মধ্যে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও রয়েছে বিভিন্ন গুজব। সুতরাং বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে কি না, স্বাস্থ্যে এর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, অর্থাৎ ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে মানুষ সুস্থভাবে কাজকর্ম করতে পারছে কি না, এসব বিষয় জনগণকে অবহিত করতে হবে। এ বিষয়গুলো যথাযথভাবে করা হলে অর্থনীতিতে কিছুটা সুফল আসবে বলে মনে করেন তিনি।

এছাড়া ভ্যাকসিন আসলে কতটা ব্যয়বহুল হবে? নাকি সরকার বিনা মূল্যে দেবে। এর দাম কত হবে? সরকার কি ভর্তুকি দেবে? নাকি বাজারমূল্যে জনগণকে কিনতে হবে? এসব বিষয়ে পরিষ্কার করতে হবে বলে মত দেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে, সরকার ১০ ডলার বা ৮০০ টাকা দিয়ে কিনছে ভ্যাকসিন। এটা সাধারণ জনগণের কাছে কিন্তু অনেক টাকা। তাই জনগণকে কমমূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ।

অতএব এই বিষয়গুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে এর সুফল আসছে কি না-তা স্পষ্ট হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে সেবা খাতে স্পষ্টত কিছুটা গতি আসতে পারে। পরিবহনে যাতায়াত, দোকানে বা বাজারে যাওয়া, হোটেলে খাওয়া-দাওয়া, মেডিকেলে, পর্যটনে, সিনেমা হলে-এসব খাতে মানুষকে মুখোমুখি যোগাযোগ করতে হয়। এতে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি থাকে। কিন্তু ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হলে এসব খাতে ভয় কিছুটা কেটে যাবে। তখন অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক ফল দেখা যাবে।

প্রায় একই মতামত প্রকাশ করেছেন তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমই-এর সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান।

ভ্যাকসিন আসায় ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভ্যাকসিন আসার খবরে মানুষের মধ্যে সাহসের সঞ্চার হয়েছে। এতে অর্থনৈতিক এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গতি আসবে। যেহেতু বিশ্বের অন্যান্য দেশে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের খবরে স্বস্তি ফিরেছে। তাই বাংলাদেশেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করি। এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। এই পরিস্থিতিটা থাকতে পারে আগামী এপ্রিল-মে পর্যন্ত। জুন থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে। অক্টোবরের দিকে করোনার প্রকোপ পুরোপুরি কমে যেতে পারে। তাছাড়া ধীরে ধীরে সবাই ভ্যাকসিনও পাবে। এতে মানুষের ভয়ও কেটে যাবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যও পুরোপুরি সচল হয়ে যাবে।

করোনা ভ্যাকসিন আসার পর রপ্তানিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে-এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল আগামী ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য বিজিএমই-এর পরিচালনা পরিষদে ‘সম্মিলিত পরিষদের’ ব্যানারে সভাপতি পদে লড়তে যাওয়া ফারুক হাসানকে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান দেশ হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা। কিন্তু সেসব এখন করোনার ভয়াবহ প্রকোপ চলছে। ফলে সেসব দেশে রপ্তানি এখন খুবই খারাপ। তবে আগামী অক্টোবর-সেপ্টেম্বরে পুরোদমে রপ্তানি শুরু হতে পারে। জায়ান্ট গ্রুপের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, করোনায় এখন কোনো রকম ব্যবসা টিকিয়ে রাখছি। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যাচ্ছে না। তবে রপ্তানির যে ধারা বর্তমানে রয়েছে, সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। তবে এই দুই অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন অন্য দুজন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। তাদের একজন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমই-এর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

তিনি বলেন, ভ্যাকসিনের কোনো প্রভাবই আমার চোখে পড়ছে না। এটা নিয়ে উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীদের মাঝে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। ভ্যাকসিন আসার কারণে করোনা নির্মূল হয়ে যাবে-এমন কোনো ভাবনা আমাদের মাঝে নেই। তাছাড়া ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর তা নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের শঙ্কা রয়েছে। এমনকি কেউ কেউ বলছেন, ভ্যাকসিন নেবেন না। আল্লাহ বাঁচাই রাখলে এমনই রাখবে।

এই শঙ্কার কারণ হলো এই ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ মারা গেছে বা যাচ্ছে। এই সংবাদ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। তাই ব্যবসা-বাণিজ্য বা রপ্তানিতে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি না।

তিনি আরো বলেন, ভ্যাকসিন আসার আগেই আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছি। কারণ, প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছি যে, করোনাকে সাথে নিয়েই ব্যবসায়িক বা উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।

অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করে এমন একটি সংস্থার একজন সিনিয়র গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করোনার ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে বিদেশে যেমন নানা প্রশ্ন উঠেছে; তেমনি দেশেও নানা সন্দেহ রয়েছে। উপকারিতা আসলে কতটুকু তা এখনো জানা যায়নি। অনুমান করাও যাবে না। যেহেতু এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তাই এর প্রভাবে অর্থনীতি গতিশীল হবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads