• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

আপসেই নিষ্পত্তি নিম্নবিত্তে

বস্তির ৯৫ ভাগ শিশু যৌন হয়রানির শিকার

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারি ২০২১

শিশু নির্যাতন বর্তমানে সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পত্রিকার পাতায় প্রায় প্রতিদিনই শিশু ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির একাধিক ঘটনা প্রকাশ পায়। গণমাধ্যমে সেসব খবরই আসে যেগুলোর অভিযোগ থানায় যায়। থানায় আসা অভিযোগগুলোর বেশিরভাগই নিম্নবিত্তের। মধ্যবিত্ত বা সমাজের উচ্চবিত্তে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে গেলেও সেগুলো থানা পর্যন্ত খুব একটা আসে না। তাদের মধ্যে রাখঢাকের প্রবণতার কারণে তারা বিচার চাইতে যায় না। নিম্নবিত্তরা থানায় অভিযোগ দিলেও সেগুলোর বিচার পর্যন্ত যাওয়ার ঘটনা খুবই কম। আপসেই তারা ঘটনার নিষ্পত্তি করে ফেলে। 

গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় রাজধানীর ৫০টি থানায় মামলা হয়েছে ৬১৭টি। এর মধ্যে শিশু-কিশোরী ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৭৮টি। ধর্ষণ মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে রাজধানীতে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসে। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় সাধারণ ছুটি চলাকালে রাজধানীর ৫০ থানায় ধর্ষণের মামলা হয় ৩৪টি। পরবর্তী সময়ে মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। এদের বেশিরভাগই নিম্নবিত্তের। শিশু নির্যাতন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, নিম্নবিত্তের শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলে থানায় অভিযোগ করতে যান অভিভাবকরা। তারা বিচারের দাবি নিয়ে গেলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় পরবর্তীতে মামলা চালিয়ে নিতে সমর্থ হন না। ফলে অপরাধীর পক্ষ থেকে আসা আপসের প্রস্তাবে তারা সহজেই সাড়া দেন এবং বেশিরভাগ সময় খুবই স্বল্প অর্থের বিনিময়ে। অপরদিকে বিত্তশালীদের পরিবারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অপরাধ ঘটলেও থানা পর্যন্ত যাওয়ার প্রবণতা কম। বাসায় অভিভাবক না থাকা, সাবলেট থাকা, প্রতিবেশীর কাছে সন্তান রেখে কাজে যাওয়া, ঘন ঘন প্রতিবেশী পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর কারণে নিম্নবিত্তের শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধীরা মনে করে তারা অপরাধ ঘটিয়ে সেটি মীমাংসা করে নিতে পারবে। অথবা মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেটি চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতাও থাকবে না ভেবে নেয়। শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজ করা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের প্রধান নির্বাহী রোকসানা সুলতানা বলেন, আমরা মূলত বস্তিতে কাজ করি। তাদের পরিস্থিতির কারণেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে বেশি। অভিভাবকরা কাজে গেলে তাদের শিশুদের প্রলোভন দেখিয়ে নির্যাতনের শিকার বানানো হয়। বস্তির ৯৫ শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে বড় হচ্ছে। ধর্ষণের আগে যৌন হয়রানিমূলক যে অপরাধের স্তরগুলো সেগুলো কেউ আমলে নিতে চায় না। ধর্ষণ হলে কেবল আমাদের নোটিশে আসে। নিম্নবিত্তের মানুষ একই ঘরে চাচা ফুফু মা বাবার সঙ্গে বাস করে। এ পরিস্থিতিতে শিশু ও কিশোরীরা নির্যাতনের শিকার হয় বেশি।

উচ্চবিত্তের মধ্যে ধর্ষণ ঘটনা তুলনামূলক কম হয়। তাদের বাসা ও জীবনযাপনের ধরনের কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটার সুযোগ কম। কিন্তু পরিবারের নিকটজনের মাধ্যমে যৌন হয়রানির ঘটনা মোটেই কম না। নিম্নবিত্তের ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ হয় বেশি। কেননা তারা থানায় অভিযোগ নিয়ে যায়। তারা বিচারটা চাইতে জানে। উচ্চবিত্তের মধ্যে রাখঢাকের প্রবণতা বেশি আর মধ্যবিত্তের প্রকৃত চিত্র কখনোই জানা সম্ভব হয় না। 

নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, ধর্ষণের মতো অপরাধ যতক্ষণ না কোনো মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত উচ্চবিত্ত নিজে থেকে তা প্রকাশ করতে আগ্রহী না। বিচার চাওয়ার চেয়ে সমাজে তার অবস্থান টলে যাবে কি না সেই শঙ্কায় থাকে উচ্চবিত্ত। নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংসতার জন্য সেই নারীটি যে দায়ী নয় সেটি তাদের মানসিকতায় ঢোকেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, নিম্নবিত্তের মানুষ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিচারের আশায় থানায় যাচ্ছে, বিষয়টা এমন নয়। যখন দেখে তাদের আর কিছু করার নাই, অসহায়ত্বের জায়গা থেকে তারা হাজির হয় থানায়। যেহেতু ঘটনা ঘটলে তাদের গোপন রাখার পথ থাকে না। আবার আপসের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকেও যায়।

তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে চলমান অপরাধ থেকে অভিযোগ না আসাটা অ্যালার্মিং। সমাজবিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে আমরা আশপাশে এ ধরনের লুকানো অনেক ঘটনা জানতে পাই, যা নথিভুক্ত হচ্ছে না। পারিবারিক অনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর অভাবের কারণে নিম্নবিত্তের শিশুরা সহজেই শিকার হচ্ছে। তবে যে মামলা নথিভুক্ত সেগুলোর শেষটা কী হচ্ছে সেই তথ্য পাওয়া গেলে পুরো চিত্রটা স্পষ্ট হতো।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শাহ আবিদ হোসেন বলেন, ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে যে সব সময় নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ বা মামলা করে থাকেন বিষয়টা এমন না। আমরা মনে করি, যারাই ভিকটিম হয়ে থাকেন তারাই আইনের আশ্রয় নেন। আর এটা তাদের অধিকার। হতে পারে নিম্নবিত্তের লোকজন ঘটনার পর সংকোচ না করে দ্রুতই অভিযোগ বা মামলা করেন। অনেকে পরে করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads