• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

রোহিঙ্গা ইস্যু

প্রত্যাবর্তনে পাশে শুধু ইইউ

  • রবিউল হক
  • প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর নিজ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার আলোচনা এখন হিমাগারে। কোভিড-১৯-এর কারণে গত এক বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে বন্ধ ছিল সব ধরনের আলোচনা। এরপর জানুয়ারিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হলেও এখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর সব উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো রয়েছে মিয়ানমারে তাদের বিনিয়োগ স্বার্থ নিয়ে। আর আন্তর্জাতিক মহল ব্যস্ত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন এখন উপেক্ষিত ইস্যু হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, মিয়ানমারের ক্ষমতা সেনাবাহিনী দখলের পর সেখানে সেনাবিরোধী বিক্ষোভ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে দেশটির সঙ্গে আলোচনার কোনো পরিবেশ বা সুযোগ কোনোটিই সম্ভব হচ্ছে না। মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ এই মুহূর্তে নেই। মিয়ানমারের নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন উত্তাল। এই অবস্থা কতদিন থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেশটির ক্ষমতা গ্রহণের পর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ইতিবাচক কথা বললেও তার নিজের অবস্থান এখন টালমাটাল। এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা নিরসন ছাড়া ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য রোহিঙ্গা নিয়ে ভাবার সময় নেই।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন নিয়ে কাজ করছেন এমন কূটনীতিকরা জানিয়েছেন আরো আশঙ্কার কথা। তাদের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পাশে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়া নেই কেউই। প্রতিবেশী ও পশ্চিমা দেশগুলো শুধু আশার বাণী শোনালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগ স্বার্থের কথা চিন্তা করে মিয়ানমারের ওপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টির অবস্থানেও যাচ্ছে না।

বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রের জানা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে খোদ প্রতিবেশী  বন্ধু দেশগুলো বিশেষ করে চীনের অবস্থান পুরোপুরি মিয়ানমারের পক্ষে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক কোনো ধরনের চাপ আসুক সেটা চায় না চীন। তাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যতবার আলোচনার প্রস্তাব এসেছে ততবার বাধা দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। এ কারণে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর গত তিন বছরেও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। আর আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের ওপর কোনো ধরনের চাপ দিতে চায় না চীনও। কারণ মিয়ানমারে রয়েছে চীনের প্রচুর বিনিয়োগ। ভৌগোলিক দিক থেকেই মিয়ানমারের অবস্থান চীনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষয়ি ইস্যু হিসেবেই আন্তর্জাতিক মহলে চালানোর চেষ্টা করে আসছে চীন।

বাংলাদেশের আরেক প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের অবস্থানও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে ততটা জোরালো নয়। ভারত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বললেও তেমন কোনো চাপ দেয়নি মিয়ানমারকে। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদানেও বিরত থেকেছে। তবে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মানবিক সাহায্য অব্যাহত রেখেছে ভারত। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও খুব বেশি জোরালো নয়, যতটা জোরালো রোহিঙ্গাদের মানবিক পরিবেশের দিকে। রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে কোটি কোটি ডলার সহযোগিতা দিলেও প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর জোরালো চাপ সৃষ্টির কাজটি করছে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলে যুক্তরাষ্ট্র জোরালো অবস্থানে থাকলেও চীন ও রাশিয়ার ভেটো দেওয়ার কারণে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তবে প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার সরকারের কিছু সেনা কর্মকর্তার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার বাইরে কিছু হয়নি।

এ ব্যাপারে জাতিসংঘের অবস্থানও দুর্বল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিভিন্ন সময় বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কাজের কাজ করেনি জাতিসংঘ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে কর্মরত জাতিসংঘের কিছু ঊর্ধ্বতনের ব্যাপারেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কারণ দুদেশে কর্মরত এসব কর্মকর্তা মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকট আছে বলেই তাদের চাকরিটা টিকে আছে। এ ধরনের মনোভাব রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা ডজনখানেক এনজিও সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যেও রয়েছে। কাজেই রোহিঙ্গা ক্রাইসিস অব্যাহত থাকুক এবং তাদের চাকরি ও বিদেশি সাহায্য সহযোগিতাও আসতে থাকুক এটাই চায় তারা। এ লক্ষ্যে তারা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের নানা ধরনের ইন্ধন দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সরকারের কাছে এ বিষয়ে প্রমাণ থাকলেও মানবিক কারনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের আরেক বন্ধু রাষ্ট্র জাপানের অবস্থানও অনেকটা পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়। কারণ মিয়ানমারে রয়েছে জাপানের অনেক বিনিয়োগ। কাজেই বিনিয়োগ সুরক্ষার জন্যই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টায় যেতে চায় না জাপান। বরং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা মুখে বললেও বিনিয়োগ স্বার্থ রক্ষায় মিয়ানমারের সাথে সুসম্পর্ক রাখার অবস্থানে দেশটি। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচের দেশগুলোকেও পাশে পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বরং তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেয়ে তাদের মানবিক দিকগুলোর দিকে নজর বেশি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা ভারে দিশেহারা ঢাকার পাশে না থেকে সৌদি আরব উল্টো তাদের দেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নিয়েছিল সম্প্রতি।

বাকি শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। রোহিঙ্গা নির্যাতনের শুরু থেকেই ইইউ ছিল প্রত্যাবাসনের পক্ষ্যে সোচ্চার। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা ছাড়াও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রস্তাব উত্থাপনে ইইউ ছিল অগ্রণী ভূমিকায়। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার ভেটো দেওয়া এবং ভারতের নিক্রিয়তায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত কোন অবস্থান নিতে পারেনি জাতিসংঘ ও ইইউ।

তবে এখন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি যতটা না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিকে, তার চেয়ে বেশি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকে। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা মুখ থুড়বে পড়লেও মিয়ানমারের সামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকবে নাকি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক (তথাকথিত সামরিক) সরকার থাকবে সেটিই মুখ্য আলোচনার বিষয় আন্তর্জাতিক মহলের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads