• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

জাতীয়

নকল ইলেকট্রনিকস পণ্যে সয়লাব

প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে নকল ইলেকট্রনিকস পণ্যে বাজার সয়লাব হলেও প্রশাসনের পক্ষে থেকে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। এসব নকল পণ্যের কারণে একদিকে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা, অন্যদিকে নিম্নমানের পণ্য থেকে সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক রেডিয়েশন, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য, বিশেষ করে চোখের জন্য ক্ষতিকর। একই সাথে নকল পণ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বৈধ ব্যবসায়ীরা। রয়েছে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব নকল পণ্যের অবৈধ কেনাবেচা।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় বেশ কিছু মার্কেট ঘিরে তৈরি হয়েছে নকল পণ্য বিক্রির চক্র। বিশেষ করে সুন্দরবন স্কয়ার, কাপ্তানবাজার, এরশাদ মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে নামিদামি ব্র্যান্ডের টিভি ও ইলেকট্রনিকস পণ্য নকল করে বিক্রি হচ্ছে। চীন থেকে নিয়ে আসা নিম্নমানের এসব পণ্যে নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো ও নাম ব্যবহার করে প্রতারিত করা হচ্ছে ক্রেতাদের।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি নকল হচ্ছে টেলিভিশন। ক্রেতাদের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য বিশেষ কৌশলে টিভিতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নামসংবলিত লেখা ইনস্টল করে দেওয়া হচ্ছে। টিভি অন করার সাথে সাথে ঐ ব্র্যান্ডের নাম টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। ফলে সহজেই তা বিশ্বাস করে ক্রেতারা। তাদের এভাবে বোঝানো হয়-‘মনোগ্রাম নকল করা গেলেও টিভির ভেতরে লোগো ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। তাই এটা আসল ব্র্যান্ডের টিভি।’ ক্রেতাও সরল মনে তা বিশ্বাস করে। আবার স্ক্রিন প্রিন্টের মাধ্যমে টিভির পেছনে নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো প্রিন্ট করে প্রতারিত করা হচ্ছে।

শুধু টিভিই নয়, এয়ারকন্ডিশন, মোবাইল ফোন সেট, রাইসকুকার, টেবিল ফ্যান, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, কফি মেকারসহ প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রনিকস পণ্যই নকল হচ্ছে। চীন থেকে নিম্নমানের এসব পণ্য আমদানি করে তাতে নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো, ষ্টিকার এমনকি ওই নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের কার্টন তৈরি করেও প্রতারণা করা হচ্ছে। টিভির পাইকারি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। নাম না প্রকাশের শর্তে সুন্দরবন স্কয়ারের এক ব্যবসায়ী জানান, তারা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে চায়না টিভি বলেই বিক্রি করেন। কিন্তু খুচরা বিক্রেতাদের অনুরোধ ও চাহিদার কারণে নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো ও সফটওয়্যার চায়না টিভিতে লাগিয়ে দেন। তার দাবি, নকল পণ্য বেচাকেনায় পাইকারি বিক্রেতাদের লাভ হয় না। কারণ খুচরা বিক্রেতারা চায়না টিভির দামেই তাদের কাছ থেকে পণ্যটি ক্রয় করেন। কিন্তু বিক্রেতারা সাধারণ ক্রেতাদের কাছে নকল টিভি নামিদামি ব্র্যান্ডের বলে বেশি দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ পাচ্ছে। অথচ দোষ হচ্ছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের। তাই তিনি খুচরা টিভির দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার পরামর্শ দেন।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এলাকার সুইমিংপুলের পেছন দিকে কয়েকটি ইলেকট্রনিকস পণ্য মেরামতের দোকানে চীন থেকে নিয়ে আসা নিম্নমানের এয়ারকন্ডিশনের বডি, কার্টন, রিমোট কন্ট্রোলসহ বিভিন্ন অংশে মূল নামটি মুছে নামিদামি ব্র্যান্ডের নাম ও লোগো স্ক্রিন প্রিন্টের সাহায্যে নকল করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি গুলিস্তান এলাকার কয়েকটি মার্কেটে অভিযান চালান র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় সুন্দরবন স্কয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ডে দেশের অন্যতম বড় ইলেকট্রনিকসের পাইকারি মার্কেট এবং পাশের এরশাদ মার্কেটে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু নকল টিভি, বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের টিভির লোগো এবং ঐসব ব্র্যান্ডের লোগো ও নামসংবলিত সফটওয়্যারের পেনড্রাইভ, নকল টিভি তৈরিতে ব্যবহূত স্ক্রিন প্রিন্টসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

বাংলাদেশ জেনারেল ইলেকট্রনিকস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে জানান, মার্কেটের ব্যবসায়ীদের আমরা এ বিষয়ে বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এখনো এই অবৈধ কাজটি করছেন। এতে মার্কেটের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে আরো কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

বাংলাদেশে স্যামসাং ব্র্যান্ডের টিভির ফ্যাক্টরি ম্যানেজার বজলুর রহমান জানান, নিম্নমানের সস্তা টিভিতে রেডিয়েশনের মাত্রা খুব বেশি। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি জানান, রেডিয়েশনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘এলইডি ব্যাক লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম’ প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হয়। এটি ব্যয়বহুল, যা সস্তা দামের টিভিতে দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশে টিভির মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মান নিয়ন্ত্রণের কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়নি। টিভির রেডিয়েশনের মাত্রা কিংবা করোসিভনেস (পার্শ্ববর্তী অন্য পণ্যের জন্য ক্ষতিকারক) সহনীয় পর্যায়ের কি না এর কোনো মান নির্ধারিত নেই। ফলে যে কেউ পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক টিভি বিদেশ থেকে নিয়ে আসছে। একই কথা মোবাইল ফোন সেটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশে ব্যবহূত একটি আন্তর্জাতিক মানের নামি ব্র্যান্ডের টিভির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, নিম্নমানের টিভি ব্যবহারে ফলে চোখের মারাত্ম ক্ষতির আশঙ্কা আছে। এছাড়া এসব টিভিতে যথাযথ আর্থিং না থাকায় যে-কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটারও আশঙ্কা আছে।

র্যাব সদর দপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, নামিদামি ব্র্যান্ডের টিভি নকল করার ফলে বিভিন্ন ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত এতে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা। দ্বিতীয়ত, বৈধ আমদানিকারকরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি হচ্ছে নিম্নমানের এসব টিভিতে রেডিয়েশনের মাত্রা খুব বেশি থাকার কারণে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads