• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একযুগ

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একযুগ

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহের একযুগ পূর্ণ হলো আজ। বহুল আলোচিত নির্মম ও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড দেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ২০০৯ সালের এদিনে পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে (বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। এতে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ নিহত হন ৭৪ জন। নিহত সেনাপরিবারের সদস্যসহ বিজিবি এবং বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় হাইকোর্ট ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন, ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা এবং খালাস দেওয়া হয় ৪৫ জন। এদিকে বিডিআর বিদ্রোহ হত্যামামলায় হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও দণ্ড কমানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা আবেদন করেছেন আপিল বিভাগে। আবার হাইকোর্টে খালাসপ্রাপ্ত ও যাদের সাজা কমানো হয়েছে সেসব আসামির বিরুদ্ধেও আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, শুধু ৯ জন আসামির আপিলে নথিপত্রে পৃষ্ঠার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৪৫। অন্য আসামির আপিলের ক্ষেত্রে এসব নথি থেকে রেহাই দিতে প্রধান বিচারপতি বরাবর আবেদন করা হয়েছে। অনুমতি পাওয়া গেলে অন্য আসামিদের জন্য আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কামাল মোল্লা, মনিরুজ্জামান, ইউসুফ আলী, আবু সাঈদ আলম, সাঈদুর রহমান, আনিসুজ্জামান, ফজলুল করিম, বজলুর রশীদসহ নয়জনের আপিল আবেদন গত ৫ জানুয়ারি আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়েছে। এসব আপিলে বিচারিক আদালতের রায়, হাইকোর্টের রায়, আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৪৫-এ দাঁড়িয়েছে। তিনি জানান, অন্য আসামিদের ক্ষেত্রে যেন এসব নথি না দিতে হয়, সে ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি বরাবরে আবেদন করা হয়েছে। তিনি অনুমতি দিলে সবার বিষয়ে আপিল করতে পারব।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এ ছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বিচার চলাকালে তৎকালীন বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়। মামলায় আসামিদের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীরও সাজা হয়। সাজা ভোগকালে ২০১৫ সালে পিন্টু অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। রক্তক্ষয়ী ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী এ বাহিনীর নাম বদল করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। এদের একজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরো ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন আসামি। সাজা হয় মোট ৫৬৮ জনের। এ মামলায় আদালত এক হাজার পৃষ্ঠার বেশি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনাকারী উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলম। ওই রায়ের ডেথ রেফারেন্স এবং আপিলের ওপর হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া যাবজ্জীবন দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আর ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় এবং খালাস পান ৪৫ জন। আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটিই দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম মামলা।

অবশেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় হাইকোর্ট পূর্ণাঙ্গ রায় দেন। এতে বিডিআর বিদ্রোহকারীদের আটটি মূল লক্ষ্যের কথা বলা হয়। বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ রাইফেলসের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য ও একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উসকানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকরা প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়ে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহ করেছে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যে-কোনো মূল্যেই দাবি আদায় করা। বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এ সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা। প্রয়োজনে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিডিআরে প্রেষণে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করা। সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪৮ দিনের নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের প্রয়াসে অস্থিতিশীলতার মধ্যে দেশকে নিপতিত করা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করা এবং  জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিডিআরের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় দেশের অন্যান্য বাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত করা।

বিডিআর বিদ্রোহের পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। এ দুটি কমিটি এ ঘটনার তদন্ত এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে সাবেক সরকারি কর্মকর্তা আনিস-উজ-জামানকে প্রধান করে সরকার একটি কমিটি গঠন করে।  কমিটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ২৩ দফা সুপারিশ করে। স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ছিল-সেনা আইনে দ্রুত বিচার করা, বিডিআরের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা, নিহত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা, অশনাক্ত মৃতদেহ শনাক্ত করা, লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করা এবং হতাহত সামরিক ও বেসামরিক লোকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ছিল-এ ধরনের জাতীয় সংকট মোকাবিলার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি ‘জাতীয় সংকট মোকাবিলা কমিটি’ গঠন করা। এ ছাড়া বিডিআর বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র যথাসময়ে উদ্ঘাটনে ব্যর্থতা এবং বিদ্রোহ দমনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যর্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads