• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

সিন্ডিকেটে জিম্মি জনশক্তি রপ্তানি

  • রবিউল হক
  • প্রকাশিত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি শ্রমবাজারে সক্রিয় হয়ে উঠছে সিন্ডিকেট প্রথা। বাংলাদেশের বেশকিছু প্রভাবশালী রিক্রুটিং এজেন্সি এবং জনশক্তি গ্রহণকারী দেশগুলোর কিছু অসৎ সরকারি কর্মকর্তার যোগসাজশে করা হয় এ ধরনের সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক দেশটিতে পেয়ে যান কর্মী পাঠানো ও নিয়ন্ত্রণের পুরো অধিকার। এতে সিন্ডিকেটভুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যেমন একচ্ছত্র ব্যবসা করে থাকেন, অন্যদিকে জনশক্তি গ্রহণকারী দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও পান কর্মী প্রতি মোটা অংকের কমিশন। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি অভিবাসন খরচও বহন করতে হয় নিরীহ কর্মীদের।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড-১৯ কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজারের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবছর যেখানে ৬ থেকে ৮ লাখ বাংলাদেশি কর্মী বিদেশে যায়, সেখানে গত বছর গেছে মাত্র ২ লাখ ১৭ হাজার কর্মী। এর মধ্যে এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাইতে বলতে গেলে কোনো কর্মীই যাইনি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বাংলাদেশের বৃহত্তম দুটি শ্রমবাজার মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখানে ফের নতুন করে সিন্ডিকেটচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর আগে ২০১৭ সালে ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করে এক বছরেই কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই সময় কর্মী প্রতি দেড় লাখ টাকা অভিবাসন খরচের কথা বলা হলেও নেওয়া হয় ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। এছাড়া বিদেশগামী কর্মীদের মেডিকেলে আনফিট দেখিয়েও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণেই গত দুই বছর ধরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধই হয়েছে এসব সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে। এক্ষেত্রে দায়ী কারো কোনো সাজা হয়নি। 

জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন জানান, মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমরা সকল রিক্রুটিং এজেন্সি বিশেষ করে যারা সক্ষম ও কোনো অভিযোগ নেই তারা সবাই যাতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায় সেটি উত্থাপন করেছি। কোনো ধরনের সিন্ডিকেটকে আমরা এককভাবে সুযোগ দিতে চাই না। এটা সরকারের পরিষ্কার অবস্থান। গত কয়েক বছর আগে থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু উদ্যোগের পরপরই শ্রমবাজারটি নিয়ন্ত্রণ নিতে তৎপর হয়ে ওঠে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া ফের বন্ধ রাখতে হয়। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে যেমন নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার, তেমনি রয়েছে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাবও। ফলে গুটিকয়েক অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারগুলো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে এবং সুনামও নষ্ট হচ্ছে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালসহ কর্মী প্রেরণকারী অন্যান্য দেশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার পরিস্থিতির পর মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নির্মাণ খাতে ফের গতি আনতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশি কর্মীদের। এছাড়া কৃষি ও কারখানাসহ অন্যান্য খাতেও অনেক চাহিদা রয়েছে। এসব দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম কর্মীদের অভাবে অনেকটাই স্থবির হয়েছে পড়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়ন ও সিন্ডিকেট চক্রের কারণে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশের বড় বড় শ্রমবাজারগুলো হারানোর পেছনে সরকারের উদাসীনতাও রয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিদেশে পাঠানো যায়, তাহলে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশিদের।

এদিকে মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে কর্মী পাঠানো অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। বিশেষ করে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নতুন করে খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গত সপ্তাহে দু’দেশের  জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠক করে। ওই বৈঠকের এজেন্ডায়ও ছিল পুরনো সিস্টেমটা আবার চালু করা। কিন্তু পুরনো সিস্টেমের সঙ্গে এসপিবিএ জড়িত। এসপিবিএ মানেই হচ্ছে সেই ১০ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট, যারা কর্মী পাঠানোর জন্য এই সিন্ডিকেট তৈরি করে পুরো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার ১০ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটে এখন যুক্ত হচ্ছে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সি। এই ২৫টি এজেন্সি মিলে সিন্ডিকেট করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই সিন্ডিকেটের বিরোধিতা করে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার প্রায় দেড় হাজার এজেন্সি। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে এসব জটিলতার কারনে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠকে শ্রমবাজারটি ফের চালু করার বিষয়ে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়।

মালয়েশিয়ার পুরনো সিস্টেম ও নতুন সিন্ডিকেট রুখতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে বায়রার একটি অংশ সিন্ডেকেট নির্মূল ঐক্যজোট (বিএসএনওজে)। তারা বলেন, দুই হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৫-৩০টি প্রতিষ্ঠানকে কর্মী পাঠানোর অনুমোদনের নামে সিন্ডিকেট তৈরির নীলনকশা করা হচ্ছে। এতে আবার দুর্নীতি হবে। আবার বিদেশে কর্মী পাঠানো বন্ধ হবে। সরকার স্বল্প খরচে কর্মী পাঠানোর কথা বললেও এই সিন্ডিকেট সাড়ে তিন লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন বক্তারা। তাই সব বৈধ এজেন্সিকে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

বায়রা সিন্ডেকেট নির্মূল ঐক্যজোটের প্রধান সমন্বয়ক শাহাদাৎ হোসেন ভূইয়া বলেন, যদি গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায় তাহলে বৈধ লাইসেন্সধারী অন্য এজেন্সিগুলোর প্রতি অবিচার করা হবে। আমরা মনে করি বৈধ লাইসেন্সধারী সবাইকে বৈধভাবে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের ২০১৩ মাইগ্রেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী বলা আছে সব মুক্ত দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত সব রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা করতে পারবে।

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের এক মালিক জানান, সিন্ডিকেট বাণিজ্যের কারণেই বৈদেশিক শ্রমবাজারে আজ এমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের আরো শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, মালয়েশিয়া অন্য ১৩টি দেশ থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী নিই না। আমাদের দেশে কেন মালয়েশিয়া চাইবে। আমরা চাই সকল যোগ্য এজেন্সি সেদেশে কর্মী পাঠানোর সুযোগ পাবে। আমরা দেখেছি ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেট প্রথা চালু হয়। এই সময়ে সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয় ছিল। অথচ তারা সর্বনিম্ন অভিবাসন ব্যয় ও শ্রমিক স্বার্থ দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads