• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

এলডিসি থেকে উত্তরণ

ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় রূপান্তরে প্রয়োজন বাণিজ্য চুক্তি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৭ মার্চ ২০২১

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। এর ফলে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জও শুরু হয়ে গেছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে পাওয়া সুবিধা হারানোর পাশাপাশি বাংলাদেশকে সংরক্ষণমূলক বাণিজ্যের পরিবর্তে বিশ্বের উদার বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। এ উদার বাণিজ্যে ঝুঁকি ও সম্ভাবনা দুটোই রয়েছে। তবে বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল বা জোটের সঙ্গে পরিকল্পিত বাণিজ্য চুক্তি করেই সম্ভাব্য এই ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় রূপান্তরের পথ তৈরি হবে। সব চুক্তির ধরন ও শর্ত এক রকম নয়। এই আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোয় দেশ বা অঞ্চল, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় জাতিগোষ্ঠী বিবেচনায় অনেক ভিন্নতাও রয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ সব সময় এগুলো বহন করার সক্ষমতা রাখে না। এ পরিস্থিতিতে কোন পথে পা বাড়াবে বাংলাদেশ? হাতে প্রস্তুতির সময় মাত্র পাঁচ বছর।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তরণের এই ঝুঁকি কমাতে পূর্বসূরিদের মতো বাংলাদেশও বাণিজ্য চুক্তি করার পদক্ষেপেই হাঁটছে। তবে কোন চুক্তিতে অগ্রসর হলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বাধিক কার্যকর হবে, তা নিয়ে সরকার এবং বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকরা জানান, উত্তরণজনিত ঝুঁকি হ্রাস এবং সক্ষমতার উন্নয়নে উত্তরণকারী দেশগুলো মোটা দাগে চারটি চুক্তিতে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। এগুলো হলো-ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি, প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি, রিজিওনাল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (আরটিএ) বা আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি এবং বিশেষ কোনো একটি দেশের সঙ্গে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) বা বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি।

এর বাইরেও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যুক্ত হতে পারে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ বা বৃহত্তর অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (আরসিইপি) অথবা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপের (টিপিপি) মতো কোনো জোটেও। তবে এর সঙ্গে দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা ও দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের মানদন্ড ও বাণিজ্যিক লাভালাভের অঙ্কটি যুক্ত।

এতসব চুক্তির মধ্যে বাংলাদেশের জন্য কোন চুক্তি উত্তরণের জন্য সর্বাধিক কার্যকর হবে, সরকারই বা কোন দিকে বেশি অগ্রসর হচ্ছে-জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশ বুঝে চুক্তি করতে হবে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, আমেরিকা, চীন এবং ভারতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার মতো সক্ষমতায় বাংলাদেশ নেই। কারণ এফটিএ মানে হচ্ছে, এসব দেশের সব পণ্যের অবাধ রপ্তানির জন্য আমাদের বাজার পুরোপুরি খুলে দেওয়া। এর চাপ দেশের শিল্পগুলো সামলাতে পারবে না। ভৌগোলিক সীমারেখার প্রেক্ষাপটে আমাদের আরটিএগুলো সেভাবে সক্রিয় নয়। খুব বেশি আরটিএ আমরা করতেও পারিনি। বাকি থাকল অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ)। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এই চুক্তিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে। কারণ এতে সব পণ্য আসবেও না, বাংলাদেশ থেকেও সবকিছু তারা নেবে না। যার যার দেশের চাহিদা অনুযায়ী চুক্তিতে উল্লেখ করা পণ্যগুলোর আমদানি-রপ্তানি হবে। তবে তালিকাভুক্ত পণ্য নির্ধারণে ভীষণ দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে হবে। আবার শুল্কহারের দরকষাকষির দূরদর্শিতাও দেখাতে হবে। আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, আপাতত পিটিএর মাধ্যমে অগ্রসর হলে সব কূলই রক্ষা হবে।

অন্যদিকে বেসরকারি আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, উত্তরণ পর্যায়ের এই প্রস্তুতিতে সময় বিবেচনায় এফটিএ-এর তুলনায় পিটিএ’র গুরুত্ব বেশি। আবার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষাপটে বড় অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোর সঙ্গে কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট বা বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তিই (সেপা) বেশি গুরুত্ব রাখে। এই চুক্তি ভারত এবং চীনসহ অনেক দেশের সঙ্গেই হতে পারে। আরটিএ বিবেচনায় তিনি আসিয়ান জোটে ভেড়ার পরামর্শ দেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়ার মতো বাণিজ্য জোটের সঙ্গেও পিটিএকে তিনি সমর্থন করেন।

এ নিয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন বলেন, বাণিজ্যকারী দেশগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আমাদের আন্তর্জাতিক চুক্তির পথে যেতেই হবে। সেক্ষেত্রে কার সঙ্গে আমরা কোন চুক্তি স্বাক্ষর করব, তা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট দেশের আগ্রহ এবং বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতির গ্রহণযোগ্য এবং প্রামাণ্য পর্যালোচনার ওপর। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির ধরন ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে। সরকার সব ধরনের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়েই চুক্তির পথে এগোচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে দেশে প্রধান এই বাণিজ্য কর্মকর্তা জানান, এলডিসি থেকে উত্তরণের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশ, অঞ্চল ও বাণিজ্য জোটের সঙ্গে চুক্তি করার লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রাথমিকভাবে বিশ্বের ১১টি দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ করার জোর প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে সেপা চুক্তি করারও উদ্যোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, এমন চুক্তিতেই যাব, যেখানে আমাদের ঝুঁকিকে সম্ভাবনায় রূপ দিতে পারব। তবে শুধু চুক্তি করলেই হবে না, এর পাশাপাশি নিজেদের আন্তর্জাতিক বাজার বিনা শুল্কে প্রতিযোগিতা করার মতো এবং মুক্ত বাণিজ্যের ধাক্কা সামলানোর মতো সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। সরকার সব দিক সামলানোরই জোরদার প্রস্তুতিতে রয়েছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে চূড়ান্ত উত্তরণ বা পদোন্নতির সুপারিশ দেয় জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (ইউএনসিডিপি)। এই উত্তরণ প্রক্রিয়ার কারণে ২০২৬ সালের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে বাজার সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রবিধান অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত সুবিধায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টিসহ বিশ্বের ৫৫টি দেশে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা (জিএসপি) পেয়ে আসছে, যা আর থাকবে না। এতে দেশের উদ্যোক্তা-রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দারুণভাবে কমে আসবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ভুটানের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর করেছে। বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে এটিই বাংলাদেশের প্রথম পিটিএ। এখন নেপালের সঙ্গেও একই চুক্তি হতে যাচ্ছে। আগামী জুনের মধ্যেই তা স্বাক্ষর হতে পারে। পিটিএ করা হবে ইন্দোনেশিয়া এবং মালদ্বীপের সঙ্গেও। এছাড়া পর্যায়ক্রমে পিটিএর তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হলো মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, মেক্সিকো, মরক্কো, কানাডা, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, মিসর এবং একটি আঞ্চলিক গ্রুপ ‘গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল’ (জিসিসি)।

অন্যদিকে এফটিএ স্বাক্ষরের তালিকায় রয়েছে ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads