• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
সেবা খাতে দুর্নীতি থামছে না!

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

সেবা খাতে দুর্নীতি থামছে না!

ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৯ মার্চ ২০২১

দেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ প্রধান ভূমিকা রাখে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নাগরিকদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সেবা গ্রহণ ও প্রদান প্রক্রিয়া সুখকর নয়।  

স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকার দেশের স্থানীয় সরকার পদ্ধতি উন্নয়নে নানা পরিবর্তন করেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক সাফল্য ও অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশিষ্টজনদের মতে, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের মৌলিক অধিকার, দৈনন্দিন জীবনযাপন ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির দুষ্টচক্র দূর করতে না পারলে সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোও ম্লান হয়ে যাবে।

জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থা ও স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় সরকার বিভাগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশে বর্তমানে ৪ হাজার ৫৫৩টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৪৯০টি উপজেলা পরিষদ, ৬৪টি জেলা পরিষদ, ৩২৪টি পৌরসভা, ১১সিটি করপোরেশন ও পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য একটি পার্বত্য জেলা আঞ্চলিক পরিষদ (পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ) রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের এসব প্রতিষ্ঠান নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের সনদ প্রদান, সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন সেবা, বিচার ও সালিশ সেবা দেওয়া, কর সংগ্রহ, বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স প্রদানসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে। এসব সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হন।

সেবা খাতে দুর্নীতি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সম্প্রতি পরিচালিত এক জরিপ প্রতিবেদনে জানা গেছে, পার্বত্য জেলা আঞ্চলিক পরিষদ ছাড়া অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ, পৌরসভা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ, সিটি করপোরেশন ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং উপজেলা পরিষদ শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে সেবা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সেবা গ্রহণকারীদের ৩৬ দশমিক এক শতাংশ দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হয়েছেন। সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছেন ২২ দশমিক ৩ শতাংশ। এ ছাড়া অর্থ আত্মসাতের শিকার হয়েছেন ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, দায়িত্বে অবহেলার শিকার হয়েছেন ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছেন ২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং প্রতারণার শিকার হয়েছেন শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ সেবাগ্রহীতা। 

জরিপে প্রতিষ্ঠানভেদে দুর্নীতি চিত্রে উঠে এসেছে,  ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেবাগ্রহীতাদের ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ দুর্নীতি এবং ২১ শতাংশ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের শিকার হয়েছেন। যেসব সেবাগ্রহীতা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছেন তারা গড়ে ৪১৭ টাকা দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সেবাগ্রহীতারা সর্বোচ্চ সিটি করপোরেশনে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন (৪১ শতাংশ) ও ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থের শিকার হয়েছেন ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এই প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৫৭৪ টাকা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত দিতে হয়েছে।  

টিআইবি’র এ জরিপ প্রতিবেদনে ঘুষ বা অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণে উল্লেখ করা হয়েছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিতে গিয়ে যেসব  সেবাগ্রহীতা ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছে তাদের গড়ে ৪৪৭ টাকা দিতে হয়েছে। বিচার ও সালিশে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৬ হাজার ২৯ টাকা এবং সনদ সংগ্রহে সবচেয়ে কম অর্থাৎ ১৩৩ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

সেবাভেদে দুর্নীতি : জরিপে সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৫২ দশমিক ১ শতাংশ সনদ সংগ্রহ করেছেন যার ৩৫ দশমিক ২ শতাংশকে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হতে হয়। সেবাগ্রহীতার মধ্যে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থের শিকার হয়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে সেবাগ্রহীতা খানার মধ্যে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ খানা এই ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে যার ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশকে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির শিকার হতে হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী খানার ৭ দশমিক ২ শতাংশকে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থের মাধ্যমে কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ নারী এবং তাদের মধ্যে ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হন। অন্যদিকে ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষ অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে ৬১ দশমিক ২ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হন। এছাড়া সেবাগ্রহীতার মধ্যে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ জমিজমা সংক্রান্ত, বিবাহ সংক্রান্ত, পারিবারিক বিরোধ, ধার-দেনা সংক্রান্ত, নারী নির্যাতন, মারামারি এবং অন্যান্য বিরোধ নিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বিচার ও সালিশের সম্মুখীন হন। এসব বিরোধ নিষ্পত্তিকালে ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতা বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হন। বিচার ও সালিশে মুখোমুখি হওয়া সদস্যদের ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ নারী এবং ৮৬ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ। এসব নারীর ৫২ শতাংশ ২ এবং পুরুষদের ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হন। তা ছাড়া ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার কারণ হিসেবে সর্বাধিক ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতা উল্লেখ করেছেন, ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না। এছাড়া ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ সেবাগ্রহীতা সময়মতো সেবা পাওয়া, ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ সেবাগ্রহীতা ফি জানা না থাকা এবং ৩ দশমিক ৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতা দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছেন।

নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার পদ্ধতি বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেছেন, বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে বিভিন্ন আইন ও বিধি দ্বারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন হয়েও পরবর্তী নির্বাচনে ভোট হারানোর ভয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ জনগণের কাছ থেকে কর, রেইট, টোল বা ফি ইত্যাদি আদায়ে সচেষ্ট না হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হাত পাতছে। ফলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই বাড়ছে। আর এতেই দুর্নীতির শাখা সৃষ্টি হচ্ছে। এ খাতের দুর্নীতি কমাতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

এ খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার ব্যাপারে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর দীর্ঘদিনের নির্দলীয় চরিত্র বজায় রাখতে ২০১৫ সালে আনীত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন আইনের সংশোধনীগুলো বাতিল করা হোক। পূর্ণ গণতান্ত্রিক চরিত্র বজায় রেখে এগুলো বাস্তবে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের অনুদান শুধু উন্নয়ন প্রকল্প ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। একটি কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যাবলি যতটা সম্ভব বজায় রেখে কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজালেই অনেকটা দুর্নীতিমুক্ত হবে।

দুর্নীতি হলো নৈতিকতার ওপর হামলাস্বরূপ উল্লেখ করে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ঘুষ যেন প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এখানেই আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। যিনি সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন তার কাছ থেকে ঘুষ ছাড়া সেবা প্রাপ্তি সম্ভবপর হয় না। যারা এই ধরনের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন তারা নৈতিকতা এবং দায়বদ্ধতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। তাই দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। নইলে সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যাবে।

ঘুষ ছাড়া সেবাপ্রাপ্তি এখন প্রায় দুরূহ উল্লেখ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক। জনগণের মৌলিক অধিকার, দৈনন্দিন জীবনযাপন ও আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য অপরিহার্য খাতগুলোতে দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতা থাকায় দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। তাই ব্যাষ্টিক পর্যায়ে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হ্রাসের প্রবণতাকে এগিয়ে নিতে আইনের কঠোর প্রয়োগ করে সকল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেবে না সরকার উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আমলাসহ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত শতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এ পর্যন্ত ১১২ জন স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads