• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
এখনো কোনো সহায়তা পাননি শ্রমজীবীরা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

এখনো কোনো সহায়তা পাননি শ্রমজীবীরা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৩ এপ্রিল ২০২১

করোনাভাইরাসের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ রোধে একদিন পর থেকে শুরু হচ্ছে কঠোর লকডাউন। সেইসাথে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। সেই লক্ষ্যে বাসায় থাকার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন উচ্চবিত্তসহ মধ্যবিত্তরা। তাদের কেউ  ভিড় করছেন কাঁচাবাজরে, কেউবা ব্যাংকে যাচ্ছেন বাড়তি টাকা তুলতে। কিন্তু বিপরীত চিত্র নিন্মমধ্যবিত্তসহ নিন্মবিত্তদের। লকডাউনের কোনো প্রস্তুতি নেই তাদের। এক সপ্তাহের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও সংগ্রহ করতে পারছেন না তারা। তাই দুশ্চিন্তার ভাঁজ এইসব খেটে খাওয়া মানুষের কপালে।

গত বছর করোনায় লকডাউনের সময় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে খাদ্যপণ্য সাহায্য করলেও এবার নেই সেই সহযোগিতাও। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী শুরু হচ্ছে কঠোর লকডাউন। গতকাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সর্বাত্নক লকডাউনের জন্য ১৩ দফা বিধিনিষেধ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে প্রজ্ঞাপন জারির পূর্বেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ১৪ এপ্রিল থেকে লকডাউন দেওয়ার কথা বলা হয়। শর্তসাপেক্ষে স্বল্প পরিসরে খুলে দেওয়া হয় মার্কেট ও গণপরিবহন। জনসাধারনকে সুযোগ দেওয়া হয় সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেওয়ার। 

গত কয়েকদিন ধরে তাই নিত্যপণ্যের বাজার, মার্কেট ও ব্যাংকগুলোতে ছিল প্রচণ্ড ভিড়। বিশেষ করে গত দুদিন এই ভিড় ছিল লক্ষণীয়। লকডাউনের কারণে ন্যূনতম এক সপ্তাহ ঘরে থাকতে হবে। সেই লক্ষ্যে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই সেরে নিচ্ছেন। সুপার শপের পাশাপাশি পাইকারি বাজার থেকেও পণ্য সংগ্রহ করছেন তারা। ব্যাংক থেকে তুলে নিচ্ছেন প্রয়োজনীয় অর্থ। গত দুদিন বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে ব্যাংকগুলোতে।

 

সরকার এক সপ্তাহের লকডাউনের ঘোষণা দিলেও বিত্তশালীরা এক মাসের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিংয়ের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে তাই নিন্মবিত্তদের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির ট্রাকের সামনে।

ধানমন্ডির বাসিন্দা আফরোজা বেগম জানান, সরকার এক সপ্তাহের লকডাউনের ঘোষণা দিলেও তা আরো বাড়তে পারে, সেই হিসাব করেই প্রয়োজনীয় বাজার সেরে নিয়েছেন। বাজারে পণ্যের স্বল্পতা না থাকলেও করোনার কারণে বার বার বাজারে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে এক মাসের বাজার করে ফেলেছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে গত দুদিন ধরে ব্যাংকগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়, যার অধিকাংশই এসেছিলেন টাকা তুলতে। পল্টনে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মাসুম মিজান জানান, গত দুদিন ধরে মানুষ যে পরিমাণ টাকা তুলছে ঈদের আগেও মানুষকে এত টাকা তুলতে দেখা যায়নি। শুধু টাকা তোলাই নয়, অনেকে আসছেন এফডিআর ভাঙাতে। অনেকে আসছেন ডিপিএস-এর টাকা তুলতে। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে অনেক ব্যাংককেই হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

লকডাউনের কঠোরতা এবং এর মেয়াদ বৃদ্ধিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের ইঙ্গিতের পর বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। তবে সেই ভিড়ে ছিল না নিন্মবিত্তদের উপস্থিতি। বেশ কিছুদিন ধরে যান চলাচল ও ব্যবসাবাণিজ্য সীমিত থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়ে অনেক শ্রমজীবী মানুষ। তাদের পক্ষে যেখানে দৈনন্দিন চাহিদা পূরণই দুষ্কর হয়ে পড়েছে সেখানে লকডাউনের জন্য অতিরিক্ত পণ্য মজুত করাটা অসাধ্য বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

মিরপুর-১০ নম্বর ফুটপাতে প্যান্ট বিক্রেতা রাসেল জানান, গত দুদিন ধরে পুলিশ ফুটপাতে বসতে দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপরই উঠিয়ে দিচ্ছে। গত রোববার বেদম লাঠিপেটাও করেছে। তারপরও লুকোচুরি করে বিক্রি করছি। এক সপ্তাহের লকডাউনের জন্য প্রস্তুতি কী জানতে চাইলে রাসেল বলেন, কীসের প্রস্তুতি! আমাদের কি জমানো টাকা আছে নাকি যে চাল-ডাল কিনে ঘড়ে মজুত করে রাখব। লকডাউনের মধ্যেও হেঁটে হেঁটে প্যান্ট বিক্রি করব। বিক্রি না করলে খাব কী!

মিরপুর গুদারাঘাটে একটি রিকশা গ্যারেজে কথা হয় সেখানকার ম্যানেজার জুয়েল রানার সাথে। তিনি জানান, তার গ্যারেজের দুই-তৃতীয়াং রিকশা চালক গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। যারা আছেন তারা বাধ্য হয়ে আছেন। কারণ গ্রামে গিয়েও তাদের কোনো কাজ নেই। রিকশাচালকদের দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, তাদের (রিকশা চালক) সবারই আয় অর্ধেকে নেমে গেছে। এখানকার আয় দিয়ে তারা গ্রামে পরিবারের ব্যয় মেটান। তাদের জমানো কোনো টাকা নেই। লকডাউন শুরু হলে এসব রিকশাচালকের দুর্দশার কোনো সীমা থাকবে না।

তার কথার সত্যতা মেলে রিকশাচালক ওয়াসিমের কথায়। তিনি জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে তার আয় অর্ধেকে নেমে গেছে। গ্রামে থাকা পরিবারের কাছে টাকাও পাঠাতে পারছেন না। লকডাউনে রিকশা চালাতে না পারলে অবস্থা আরো করুণ হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, গত বছর করোনার সময় বেশ কিছু সাহায্য পেয়েছিলেন। তা দিয়ে কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এবার কেউ সাহায্যও দিচ্ছে না। যদি রিকশা চালাতে না পারেন, আবার সরকার যদি সাহয্যও না করে তাহলে করোনা লাগবে না, না খেয়েই মরতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শ্রমজীবী মানুষদের চাইতে আরো যেন করুণ দশা নিন্মমধ্যবিত্তদের। তাদের বালিশ চাপা কান্না যেন আরো করুণ। রাজধানীর নাখালপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল হোসেন চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। করোনার কারণে গত বছরের শেষ দিকে কর্মী ছাঁটাইয়ের তালিকায় আসে তার নামটি। এরপর জমানো টাকায় কোনোমতে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে জীবন চালালেও এখন রিক্ত হস্ত তার। একসময়ে ভালো জীবনযাপনে অভ্যস্ত মধ্যবিত্তের কাতারে থাকা নাজমুল এখন নিন্মবিত্তের কাতারেও নিজেকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। না পারছেন কারো কাছে সাহায্য চাইতে, না পারছেন নতুন কোনো কর্মসংস্থান করতে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads