• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ভয়াবহ হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি

ছবি : সংগৃহীত

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ভয়াবহ হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১২ জুলাই ২০১৯

দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদী ও হাওরে পানি বাড়ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। তিস্তার পানিপ্রবাহ বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার কারণে পানিবন্দি কয়েক হাজার মানুষ। বাংলাদেশের খবরের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে এমন চিত্র ফুটে উঠেছে।

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জ জেলার নদী ও হাওরে পানি বাড়ছে। এতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ইতোমধ্যে জেলার আটটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব উপজেলার সড়ক, ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। বর্তমানে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার ১৬৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে এমন তথ্য জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পানি প্রবেশ করায় পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ২২টি, দোয়ারাবাজার উপজেলার ১৮টি, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ২৭টি, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ৩টি, ছাতক উপজেলার ১০টি, জামালগঞ্জ উপজেলার ৩০টি, তাহিরপুর উপজেলার ১৯টি ও ধরমপাশা উপজেলার ৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এছাড়া যেসব এলাকার বিদ্যালয়গুলো উঁচু স্থানে রয়েছে সেগুলোতে অতিবৃষ্টিতে প্লাবিত হওয়া মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষক ও দপ্তরিকে সার্বক্ষণিক বিদ্যালয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অবনতি হয়েছে লালমনিরহাটের বন্যা পরিস্থিতিও। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তিস্তার পানিপ্রবাহ বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে লালমনিরহাটে প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গতকাল সকাল ৬টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৬২ সেন্টিমিটার, যা স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। পানি বেড়ে বিকাল ৩টায় তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ (রেকর্ড করা হয়) বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে গত বুধবার মধ্যরাত থেকে তিস্তার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্ল­াবিত হয়। ভারী বৃষ্টিতে অনেক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। নৌকা বা ভেলা ছাড়া চরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে বড় সমস্যায় পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। এ বন্যায় জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুনা, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী; কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা; সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, কুলাঘাট ও মোগলহাট ইউনিয়নের তিস্তা ও ধরলার নদীর চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এদিকে নতুন করে বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী জেলা। ফেনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীতে মুহুরী-কহুয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ফুলগাজী ও পরশুরাম অংশে ১২টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর ফলে প্লাবিত হয়েছে প্রায় ১৭টি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। সেখানকার বাড়িঘর, বীজতলা, সবজিক্ষেত, মাছের ঘের, পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। বসতঘর, রান্নাঘরে পানি ওঠার কারণে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। মুহুরী নদীর পরশুরামের অংশে মঙ্গলবার রাতে ৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। চিথলিয়া ইউনিয়নের উত্তর শালধর গ্রামের মহসিন মেম্বার বাড়ি সংলগ্ন, দুর্গাপুর গ্রামের কালাম মেম্বারের বাড়ি সংলগ্ন স্থান, পৌর এলাকার বেড়াবাড়ীয়া শাহপাড়া গ্রামে সংলগ্ন স্থান, উত্তর ধনিকুণ্ডা বদু মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন, নোয়াপুর, উত্তর ধনিকুণ্ডা, চিথলিয়া, শালধর, রাজষপুর, দুর্গাপুর, নোয়াপুর, রামপুর, বেড়াবাড়ীয়া, অলকাসহ ৯টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ফুলগাজী উপজেলার মুহুরী নদীর বিভিন্ন স্থানে ৭টি ভাঙনে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার জয়পুরের ঘনিয়া মোড়ায় তিনটি স্থানে, উত্তর শ্রীপুর গ্রামের পূর্ব পাড়া, সাহাপাড়া দুটি স্থানে, বক্সমাহমুদ কাপ্তান বাজার এলাকায় ২টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। এতে উপজেলার অন্তত ৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে উত্তর শ্রীপুর, দক্ষিণ শ্রীপুর, নীলক্ষি, কিসমত ঘনিয়া মোড়া, পশ্চিম ঘনিয়া মোড়া, জয়পুর, শাহাপাড়া, বৈরাগপুর গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

অবনতি হয়েছে দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতিও। তিন দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের সব নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করেছে। পানি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকায় দু-এক দিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদ-নদীর পানি বাড়ায় চরাঞ্চলের শতাধিক গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে নিচু এলাকার কিছু কিছু বীজতলা, ভুট্টা ও সবজির ক্ষেত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে এবং বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হবে। তবে ব্যাপক বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই বলে তিনি আশ্বস্ত করেছেন। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গেল ২৪ ঘণ্টায় ধরলা নদীর পানি ৩৭ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের চিলমারী পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ৪৫ সেন্টিমিটার এবং তিস্তায় ১৩ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখনো বিপদসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

শেরপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত ৩ দিন ধরে অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে মহারশী নদীর দীঘিরপাড় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ৩টি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষকদের বীজতলা। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোচনীপাড়া-বাগের ভিটা রাস্তা বিধ্বস্ত হয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ঝিনাইগাতী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন জানান, পাহাড়ি ঢলের পানিতে ছুড়িহারা, দিঘিরপাড়, চতল, রামনগর, কালিনগর, দরিকালিনগর, বালুরচর, দারিয়ারপাড়সহ কয়েকটি গ্রামের শত শত মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষকদের বীজতলা।

অবনতি হয়েছে বান্দরবানের বন্যা পরিস্থিতিরও। ফলে বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণে পর্যটকদের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সড়ক প্লাবিত হওয়ায় বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ তৃতীয় দিনের মতো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এছাড়া বন্ধ রয়েছে রুমা ও থানচিতে সবগুলো রুটে নৌ-চলাচলও। প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাই এ সময়ে পর্যটকদের ভ্রমণে আসতে নিষেধ করেছেন। ভারী বর্ষণে সাঙ্গু নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী তীরবর্তী উজানীপাড়া, মধ্যমপাড়া, মুসলিমপাড়াসহ আশপাশের শত শত ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। জেলা সদরের মেম্বারপাড়া, ওয়াবদাব্রিজ, কাশেমপাড়া, শেরেবাংলা নগর, ইসলামপুরসহ আশপাশের নিম্নাঞ্চলের কয়েক শতাধিক ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বান্দরবান জেলা প্রশাসক মো. দাউদুল ইসলাম জানান, ১২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৭শ দুর্গত মানুষ অবস্থান করেছে। পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রাণ তৎপরতা চালানো হচ্ছে। এছাড়া বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

এদিকে গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে আরেক পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চেঙ্গী নদীর পানি কমতে শুরু করলেও অপরিবর্তিত রয়েছে মাইনী নদীর পানি। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। গেল পাঁচ দিনে খাগড়াছড়িতে ৩৪২ দশমিক ছয় মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এদিকে জেলার ৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ১২টি কেন্দ্রে প্রায় তিন হাজার পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads