বন্যার পানি নামতে শুরু করায় জেগে উঠছে রাস্তাঘাট। পানির প্রচণ্ড তোড়ে বন্যাকবলিত এলাকার বেশিরভাগ রাস্তাঘাটেরই বেহাল দশা। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে দুর্গত এলাকার মানুষদের। তবে বন্যা মোকাবেলায় ২২টি মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে।
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রামে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। পরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভায় অংশগ্রহণ করেন।
সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কোনো দুর্ভোগ থাকবে না, কোনো আতঙ্ক থাকবে না। ভয়ের কোনো কারণ নেই, এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সক্ষমতা সরকারের আছে। বন্যা মোকাবেলায় ২২টি মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে। আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে কাজ করছি। সবার আগেই ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছি আমরা।
তিনি আরো বলেন, কুড়িগ্রামের দুর্ভোগ লাঘবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সরকারের সঙ্গে বন্যা সহনীয় কুড়িগ্রাম জেলা গড়ার লক্ষ্যে এ জেলার সব নদীর দুই তীরে বাঁধ নির্মাণ ও খননের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ১৬টি নদী জেলাবাসীর জন্য আর দুঃখ নয়, আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে।
এ সময় কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. পনির উদ্দিন আহমেদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এরপর প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান উলিপুরে এম এ মতিন কারিগরি কলেজ, চিলমারীতে ফুড গোডাউন এবং রৌমারী ও চর রাজীবপুর উপজেলায় ত্রাণ বিতরণ করার পাশাপাশি বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে তিনি স্পিডবোটে জামালপুরের উদ্দেশে রওনা দেন।
জামালপুর প্রতিনিধি জানান, বন্যার পানি নামতে শুরু করায় জেগে উঠছে রাস্তাঘাট। পানির প্রচণ্ড তোড়ে লন্ডভন্ড হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে জেলার বেশিরভাগ রাস্তাঘাট। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দুর্গত এলাকার মানুষ। কোনো কোনো এলাকায় ভাঙা রাস্তার ওপর স্থানীয়ভাবে তৈরি বাঁশের নড়বড়ে সাঁকোর ওপর দিয়ে চলছে যাতায়াত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জামালপুরে বন্যার পানি কমার সঙ্গে ভেসে উঠছে বিধ্বস্ত বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটের ধ্বংসস্তূপ। জামালপুর-সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ-মাহমুদপুর, ইসলামপুর-গুঠাইল, দেওয়াগঞ্জ-সানন্দবাড়ি, সরিষাবাড়ি-তারাকান্দি, বকশীগঞ্জ-জামালপুরসহ অনেক রাস্তা ভেঙে বন্ধ রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। টানা ৭ দিনের বন্যায় পানির তোড়ে রাস্তা লন্ডভন্ড হওয়ায় ইসলামপুর, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ি ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সদরের সঙ্গে বেশিরভাগ ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। ওইসব ইউনিয়নে পৌঁছানো যাচ্ছে না বন্যার্তদের ত্রাণসামগ্রী। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। সাধারণ মানুষের দাবি, রাস্তাঘাটগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যেই মেরামত করে তাদের দুর্ভোগ কমিয়ে আনা হোক।
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় রেললাইনের ৫০ ফুট এলাকার নিচের মাটি সরে ধসে গেছে (ওয়াশ আউট)। এ কারণে ঢাকার সঙ্গে দেওয়ানগঞ্জ সরাসরি আন্তঃনগর তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ এ পথে চলাচলকারী সব ট্রেন এখনো বন্ধ রয়েছে। এ পথে উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধার ফুলছড়ি, বোনারপাড়া কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর, বকশীগঞ্জ, বাহাদুরাবাদে শতশত যাত্রী ট্রেনযোগে চলাচল করে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৭টি উপজেলার সর্বশেষ ৬২টি ইউনিয়নে ৮টি পৌরসভার মধ্যে ৭টি বন্যাকবলিত হয়েছে। সারা জেলায় ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫৩০টি পরিবারের মোট ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৯০ জন লোক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জামালপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবারের বন্যায় জামালপুর সড়ক বিভাগের প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে জামালপুর-সরিষাবাড়ি সড়কের ২০ মিটার সড়ক ধসে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি নামামাত্রই ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাগুলো মেরামতের ব্যবস্থা করা হবে।
বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ায় যমুনা নদীর সারিয়াকান্দি পয়েন্টে আবারো পানি বাড়তে শুরু করেছে। যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঙালি নদীর পানি ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বাঙালি নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে সারিয়াকান্দি পৌর এলাকার অধিকাংশ নিচু এলাকার বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। সেই সঙ্গে বাঁধের পশ্চিমাঞ্চলে সারিয়াকান্দি, গাবতলী, শেরপুর, ধুনট ও সোনাতলার অধিকাংশ ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গাইবান্ধার বাঁধভাঙা পানি বাঙালিতে প্রবেশ করায় এ অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে।
এবারের বন্যায় সরকারি হিসাবে বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা এখন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ২৯টি ইউনিয়নের ৫৬৯টি গ্রামের ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ২ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যার কারণে ২৩ হাজার ৩০ হেক্টর কৃষিজমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩১৫টি পুকুরের ২ কোটি ৯৪ হাজার টাকা মূল্যের ৮৬.৭০ টন মাছ ভেসে গেছে। বন্যার কারণে ৩০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ও ৫৮.১৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।