• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বন্যায় দুই সপ্তাহে মৃত্যু ১০১

ছবি : সংগৃহীত

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

বন্যায় দুই সপ্তাহে মৃত্যু ১০১

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০১৯

দেশের বড় নদ-নদীগুলোর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি আর উজান থেকে নামা ঢলে বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে মানুষের দুর্ভোগ ক্রমশ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।

এর মধ্যে বন্যায় দুই সপ্তাহে পানিতে ডুবে, সাপের ছোবলে, পানিবাহিত রোগে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বন্যার কারণে দুর্ভোগের পর এখন প্রতিদিন বহু মানুষ বিভিন্ন রোগের শিকার হচ্ছেন। এরই মধ্যে সাড়ে ১১ হাজার মানুষ ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ২৮ জেলায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ৭০টি উপজেলাকে ‘দুর্গত এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় আড়াই হাজার মেডিকেল টিম কাজ করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, ১০ জুলাই থেকে দুর্গত এলাকায় বিভিন্ন কারণে (ডায়রিয়া, সাপে কাটা, পানি ডোবা ইত্যাদি) ১০১ জন মারা গেছেন।

এর মধ্যে জামালপুরে সর্বোচ্চ ৩৩ জন, নেত্রকোনায় ১৬ জন, চট্টগ্রামে একজন, কক্সবাজারে একজন, বগুড়ায় চারজন, গাইবান্ধায় ১৭ জন, লালমনিরহাটে চারজন, নীলফামারীতে দুজন, সুনামগঞ্জে পাঁচজন, কুড়িগ্রামে পাঁচজন, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজন করে, টাঙ্গাইলে সাতজন এবং ফরিদপুরে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে পানিতে ডুবে ৮৩ জনের, বজ্রপাতে সাতজনের, সাপের ছোবলে আটজনের, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে একজন এবং অন্যান্য কারণে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানায়, গেল দুই সপ্তাহে ১১ হাজার ৩৫৩ জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ২৯৫ জন অসুস্থ হয়েছেন; তাদের সাতজনের মৃত্যু হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানান, বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল ও মেঘালয়ের বিভিন্ন স্থানে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের শঙ্কা রয়েছে।

দেশের নদ-নদীগুলোর ৯৩টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে এখনো ১৮টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বুধবার ৪৩টি পয়েন্টে পানি কমেছে, বেড়েছে ৪৬টি পয়েন্টে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে; সেই সঙ্গে অবনতি হচ্ছে মধ্যাঞ্চলে।

সার্বিকভাবে আগামী সপ্তাহের শেষে এ দফার বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে। তবে উজানে আগামী কয়েক দিন বৃষ্টি থাকলে সেই উন্নতি বিলম্বিত হবে।

জামালপুরে চোখ রাঙাচ্ছে বন্যা : জামালপুরে নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে বন্যা। গত ১২ ঘণ্টায় ৮ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টায় জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্ট এলাকায় যমুনার পানি বিপৎসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) পানি পরিমাপক (গেজ রিডার) আবদুল মান্নান এ তথ্য জানান। বৃষ্টি ও দ্রুত পানি বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন এলাকায় আবারো পানি ঢুকতে শুরু করেছে।

এদিকে গত ২ সপ্তাহের বন্যায় এখন পর্যন্ত ঘরে ফিরতে পারেনি বন্যার্তরা। তারা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ও রাস্তায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। পানি সরে যাওয়ায় ফুটে উঠেছে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, সরিষাবাড়ী, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ ও বকশীগঞ্জের কোনো কোনো এলাকায় বন্যায় তলিয়ে যাওয়া রাস্তা ভেসে উঠলে এসব ক্ষয়ক্ষতি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এসব রাস্তায় যান চলাচল সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়নের সঙ্গে উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

নতুন করে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাও বাড়ছে বন্যার্তদের। সরকারিভাবে যেসব ত্রাণ আসছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। এ অবস্থায় নতুন করে আবারো বাড়িঘর প্লাবিত হলে মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।

এদিকে বন্যার কারণে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের তীব্র অভাব দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির কারণে খোলা আকাশের নিচে বসবাসকারী বন্যার্তদের চরম কষ্টে পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে গবাদিপশুর খাবার সংকটে পড়েছেন বন্যার্তরা।

বন্যার ফলে সবজি বাগান নষ্ট হওয়ায় বাজারে প্রতিটি সবজির দাম এখন দ্বিগুণ। কাঁচা মরিচের দাম এখন প্রতি কেজি ২০০ টাকা। পটোল ৮০, দেশি কাকরোল ৬০, পেঁয়াজ ৫০, আলু ২০, ঝিঙা ৮০, করলা ১২০ টাকা কেজি।

কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই নতুন করে আবারো দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়েছে কুড়িগ্রাম। এতে বানভাসিদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। 

ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আবারো অবনতি হয়েছে।

নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়ছে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো। গত এক সপ্তাহ ধরে নদ-নদীর পানি হ্রাস পেয়ে বিপৎসীমার নিচে নামলেও গত মঙ্গলবার থেকে নতুন করে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫১ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এতে করে বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই নতুন করে আবারো দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়ায় বানভাসিদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। হাতে কাজ ও ঘরে খাবার না থাকায় চরম খাদ্য সংকটে পড়েছেন চরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত মানুষ।

এদিকে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চরাঞ্চলের চারণভূমি তলিয়ে থাকায় গবাদিপশুর খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। এ বছরের বন্যায় এ পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে জেলার বন্যাকবলিত ৮ লক্ষাধিক মানুষের জন্য সরকারিভাবে ১ হাজার টন চাল, ৭ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে সামান্য ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

এ ছাড়াও জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বিশেষ সভায় অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানের নির্দেশে ৫০০ টন জিআর চাল, ১০ লাখ টাকা, ৪০০ বান্ডেল ঢেউটিন, গৃহনির্মাণ বাবদ ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ১ হাজার দুর্যোগ সহনীয় ঘর তৈরি এবং ৩ মাসের জন্য ভিজিএফ চলমান রাখার বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মধ্যাঞ্চল ছাড়া বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে : মধ্যাঞ্চল ছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে এখনো প্রধান নদ-নদীর পানি ১৯ পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল শুক্রবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চচল বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। অপরদিকে মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। এ সময়ে কুশিয়ারা এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীসমূহ ব্যতীত অন্য সব নদ-নদীর পানি হ্রাস পেতে পারে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যমুনা নদী ব্যতীত দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে সুরমা, কুশিয়ারা, সোমেশ্বরী, তিতাস, ধরলা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, ধলেশ্বরী ও পদ্মা নদীর পানি ১৯ পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে সর্বোচ্চ ৫৫ ও ফুলছড়িতে ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads