• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
পদ্মার পানি বিপৎসীমায়, ডুবছে চরের গ্রাম

পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নাটোরে ডুবে গেছে সবজি ও আখ ক্ষেত

ছবি: বাংলাদেশের খবর

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়েছে ভারত

পদ্মার পানি বিপৎসীমায়, ডুবছে চরের গ্রাম

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ০২ অক্টোবর ২০১৯

ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যা থেকে বিহারের রাজধানী পাটনাসহ আরো ১২ জেলাকে রক্ষায় ফারাক্কা বাঁধের ১১৯টি গেটের সবকটি খুলে দিয়েছে ভারত। সে দেশের স্থানীয় এমপির অনুরোধে কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নেয় বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সংবাদে জানানো হয়েছে। জি নিউজের অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের একাংশ ও বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

উজানে অতি বৃষ্টির কারণে ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দেওয়ায় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর অববাহিকাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায়।

রাজশাহীতে গত রোববার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে গত সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পদ্মা নদীতে ১১ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মা নদী বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় ৪২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই পানি বৃদ্ধির কারণে রাজশাহীর জেলার চরাঞ্চলের গ্রামগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। পবা, বাঘা ও গোদাগাড়ীতে ভাঙনও দেখা দিয়েছে।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, রাজশাহীতে গত রোববার সকাল ৯টা থেকে গত সোমবার সকাল নয়টা পর্যন্ত ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে হয়েছে ৫৪ মিলিমিটার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে হয়েছে ৬৮ মিলিমিটার। এই পানি নদীতে জমা হয়েছে। এসব কারণে পদ্মা নদীতে পানি বাড়ছে। ভারতেও বৃষ্টি হয়েছে। ফলে উজানের পানিও বাংলাদেশে আসবে।

এদিকে বন্যায় ভারতের দুই রাজ্যে ৪৮ জন মারা যাওয়ায় সে দেশের বিরোধী দল কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী কেন্দ্রীয় সরকারকে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের বন্যা পরিস্থিতির প্রতি নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

জানা গেছে, সোমবার ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের একাংশ ও বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। মালদা জেলার ফুলহর, মহানন্দা ও কালিন্দী নদীতে পানি বাড়ছে। সেখানে একাধিক জায়গায় নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। চরম বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে গঙ্গা ও ফুলহর।

অবশ্য রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, সাধারণত বাংলাদেশের পাঙ্খা পয়েন্টে ফারাক্কার পানি বৃদ্ধি পেলে ভরা মৌসুমে রাজশাহীতে প্রায় ছয় ঘণ্টার মধ্যে সেই পানি চলে আসে। পাঙ্খা পয়েন্ট থেকে রাজশাহীর দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার।

ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়ার কারণে রাজশাহীতে পদ্মার পানি বাড়ছে কি না সে ব্যাপারে গত সোমবার রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, প্রতি বছরই জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খোলা থাকে। এটি নিয়মিত ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। প্রকৃতপক্ষে গত কয়েক দিন ধরে গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকায় নিম্নচাপজনিত অতিবৃষ্টির কারণে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উজানে ভারতের বিভিন্ন জেলায় এবং ভাটিতে বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির জন্য সতর্ক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে পদ্মায় পানি বৃদ্ধির কারণে রাজশাহীর জেলার চরাঞ্চলের গ্রামগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। পবা, বাঘা ও গোদাগাড়ীতে ভাঙনও দেখা দিয়েছে।

গত দুই সপ্তাহে পানি বৃদ্ধির কারণে রাজশাহীর পবা উপজেলার চরখিদিরপুর ও মধ্যচরে ব্যাপক বন্যা ও নদীভাঙন শুরু হয়েছে। মধ্যচরে পদ্মার তীব্র ভাঙনে আড়াইশ পরিবারের বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একই অবস্থা হয়েছে রাজশাহী বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই পানিতে তালিয়ে গেছে। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল আযম জানান, সেখানেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে সেখানকার প্রায় ১২০টি পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। তার ইউনিয়নে মোট ৩ হাজার ৬০০ পরিবারের মধ্যে আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেখানে পানি দ্রুত বাড়ছে।

রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বলেন, তার ইউনিয়নের মধ্যচর পদ্মার ভাঙনে একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। আর চরখিদিরপুরের দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শতভাগ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

হঠাৎ করে সব গেট খুলে দেওয়ার বিষয়ে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জ) সৈয়দ সাহিদুল আলম বলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এক দিনে ১১ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে হয়তো সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও টানা বর্ষণের কারণেও পদ্মার পানি বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে ১৭ দশমিক ৯৮ সেন্টিমিটারে। দুদিনের মধ্যে বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার অতিক্রম করতে পারে। এতে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

গোদাগাড়ী (রাজশাহী) থেকে সেলিম সানোয়ার পলাশ জানান, মরণবাঁধ ফারাক্কার প্রভাবে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হুহু করে বাড়ছে রাজশাহীর পদ্মা নদীর পানি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ। আশ্রয় নিতে শুরু করেছে স্কুলগুলোতে। কেউ কেউ চরাঞ্চল ছাড়তে শুরু করেছে। গরু, ছাগল, হাঁস- মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টায় পদ্মায় পানির উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৪ মিটার। অর্থাৎ বিপৎসীমার মাত্র ৪৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপাত্ত সংগ্রহকারী এনামুল হক এসব তথ্য জানিয়েছেন। বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী বলেন, পদ্মায় পানি বাড়লেও শহরে এখনো তা ঢুকবে না। শহরের সঙ্গে সংযুক্ত স্লুইসগেটগুলো শিগগিরই বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে গোদাগাড়ী, পবা, বাঘা ও চারঘাটের চরাঞ্চলে বন্যায় ক্ষতির আশঙ্কা আছে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, চরাঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে। চরাঞ্চলের মানুষ বিদ্যালয়গুলোতে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তারা মঙ্গলবার সকাল থেকে চরাঞ্চল ছাড়তে শুরু করেছে

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে জাহিদ হাসান মাহমুদ মিমপা জানান, চাঁপাইনাবগঞ্জে পদ্মা ও মহানন্দা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও আরো নতুন করে ৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৫২ মিমি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে এ জেলায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, পদ্মায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার .৫৬ সেন্টিমিটার (বিপৎসীমা ২২.৫০ সেমি) এবং মহানন্দায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১২ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার .৫৮ সেন্টিমিটার (বিপৎসীমা ২১ সেমি) নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

জেলার সদর উপজেলার আলাতুলি, নারায়ণপুর, চর অনুপনগর, শাহজাহানপুর ও চরবাগডাঙ্গা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে নতুন করে পানি প্রবেশ করেছে। এই ৫ ইউনিয়নে ২ হাজার ২শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা, দুর্লভপুর, মনাকষা, উজিরপুর, ধাইনগর, ঘোড়াপাখিয়া ও ছত্রাজিৎপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

চরবাগডাঙ্গা ইউপির ৯ ওয়ার্ড সদস্য মো. কামরুজ্জামান টুটুল জানান, গোঠাপাড়া, বাগানপাড়া, চাকপাড়া, গিধনিপাড়া, মালবাগডাঙ্গা গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় ৫শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চরবাগডাঙ্গা বিওপি এলাকার গিধনিপাড়ায় নদীভাঙন দেখা দিয়েছে।

শাহজাহানপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুস সালাম জানান, হাকিমপুর, সেকালিপুর রাবনপাড়া, দুর্লভপুর ও নরেন্দ্রপুরের কিছু  নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় প্রায় ৪শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো রান্না করতে পারছে না।

শিবগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, পাকা, দুর্লভপুর, মনাকষা, উজিরপুর, ধাইনগর, ঘোড়াপাখিয়া ও ছত্রাজিৎপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় সাড়ে ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

 

কুষ্টিয়া থেকে জাহাঙ্গীর হোসেন জুয়েল জানান, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পদ্মা নদীর পানি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরসহ বেশ কিছু নিম্নাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রতি ঘণ্টায় পানি বাড়ছে এক সেন্টিমিটার করে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পানি পরিমাপ করার পর দেখা যায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার অতিক্রম করেছে।

কুষ্টিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্যমতে, কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি প্রবাহের বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার দুপুর ৩টায় পানি প্রবাহের মাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ২৮ সেন্টিমিটার। গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি বেড়েছে ২০ সেন্টিমিটার।

এদিকে পদ্মার শাখা গড়াই নদীতেও পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখনো গড়াই নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পীযূষ কৃষ্ণ কুণ্ডু জানান, পানি এই মুহূর্তে বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় কখনো ১ সেন্টিমিটার আবার কখনো ২/৩ সেন্টিমিটার করে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়িত মনিটরিং করছি।

সুনামগঞ্জ থেকে শাহাবুদ্দিন আহমেদ জানান, সুনামগঞ্জে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। গত সোমবার রাত ৯টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ বৃষ্টিপাতের ফলে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে এবং সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads