• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
হারলে শেষ, জিতলে বাংলাদেশ

বিডিজি-মাগুরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন

ছবি : বাংলাদেশের খবর

সংবাদ-ভাষ্য

ছাত্র আন্দোলন

হারলে শেষ, জিতলে বাংলাদেশ

  • মোস্তাফা কামাল মহীউদ্দীন
  • প্রকাশিত ০৬ আগস্ট ২০১৮

শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আমাদের নৈতিক ভিতকে জাগিয়ে দিয়েছে। অনৈতিক আয়ে পথ হারিয়েছিলাম আমরা। সে পথ দেখলাম। এবার ক্লাসে ফেরার পালা।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিরল ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে দেশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা। সাধারণ মানুষ থেকে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচিত এই আন্দোলনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিনে এই ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলে। দেশের গণমাধ্যম ছাড়াও বিদেশি গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ ও শিক্ষণীয় এই আন্দোলনের খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে। এই আন্দোলন অধিকার সচেতন প্রজন্মের জন্য গর্বও কুড়িয়েছে। কিশোর ছাত্রদের আন্দোলনে ফুটে উঠেছে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সোনালি চিত্র।

বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থায় নৃশংসতার শিকার হয়ে নিহত হয় রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রছাত্রী দিয়া ও রাজিব। দুই সহপাঠীকে হারিয়ে ঘটনার দিন ২৯ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর ছাত্ররা। একে একে আন্দোলনে যুক্ত হয় রাজধানীর সব স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা, যা পরে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও সরকারের নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এই দুর্ঘটনাকে হাস্যরসে স্বাভাবিক ও পাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করায় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। মর্মন্তুদ এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীর এমন বক্তব্য যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হয় দেশের সর্বস্তরের মানুষ। নিরঙ্কুশ গ্রহণযোগ্যতা পায় কিশোর ছাত্রদের আন্দোলন। 

২৯ জুলাই থেকে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে উঠে আসে নয় দফা দাবি। পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন শুরু করে ছাত্ররাই। গাড়ির ফিটনেস যাচাই, ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করা, উল্টো পথে গাড়ি না চালানো, লেন মেনে চলাসহ জনসচেতনতামূলক কাজ করে দৃষ্টান্ত গড়ে। মন্ত্রী, বিচারপতি, দুদকের কর্মকর্তা, র‌্যাব-পুলিশের গাড়িসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্তাদের গাড়িও ছাত্রদের তল্লাশি থেকে বাদ পড়েনি। দাফতরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তারাও যে এতদিন অনিয়মের জালে ছিলেন তাও জাতির কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে এই ছাত্ররা। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল সবাই স্বীকারও করেছেন- ছাত্রদের আন্দোলন যৌক্তিক এবং তারা আমাদের নৈতিক ভিতকে জাগিয়ে তুলেছে। আন্দোলনের চতুর্থ দিনে ছাত্রদের নয় দফা দাবি মেনে নেয় সরকার এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও শুরু করে।

এদিকে ছাত্রদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির নিম্নরুচির মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফটোশপে এডিট করা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ও অশ্লীল ফেস্টুন ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে। ছাত্রদের সহনশীল আচরণের পরামর্শ না দিয়ে উত্তেজিত করার মতো উসকানি দিচ্ছে। পাশাপাশি চলছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চর্চাও। দেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াবিদ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ছাত্রদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করে বলছেন- যেহেতু সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়েছে, সেহেতু ছাত্রদের উচিত এখন ক্লাসে ফিরে যাওয়া।

ছাত্রদের অভূতপূর্ব এই আন্দোলন দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তবে আন্দোলনের দীর্ঘসূত্রতা এখন গৌরবদীপ্ত অর্জনকে ম্লান করছে। প্রথম দিকে আন্দোলনের প্রতি সর্বসাধারণের সহনশীল সমর্থন থাকলেও টানা এক সপ্তাহের দুর্ভোগে সারা দেশের জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা নিরাপত্তার অজুহাতে অঘোষিতভাবে যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছে, দুর্ভোগ বাড়ছে প্রতিদিন। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পণ্যমূল্যের দাম। পরিবহন সঙ্কটে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের আমদানি ও রফতানি। ছাত্রদের এই আন্দোলন সর্বস্তরের মানুষের কাছে এখন দুর্ভোগের। দেশের সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ বলছে- ‘ছেলেমেয়েদের আন্দোলনে আমরা গর্বিত; পরিবহন আইনের যুগোপযোগী সংস্কার হচ্ছে।’ যে কাজটি আমরা করতে পারিনি তারা সেটি করে দেখিয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিংবদন্তি নেতা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ টানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৩ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন- সম্মান থাকতে সরে যাওয়া ভালো। সুতরাং ছাত্রদেরও উচিত তাদের কষ্টার্জিত অর্জন প্রশ্নের মুখে পড়ার আগে ক্লাসে ফিরে যাওয়া। সব কিছুরই সীমা থাকা উচিত। সীমা লঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। ধৈর্য মহৎ গুণ। ইসলাম ধর্মের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি তেমনি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

ষষ্ঠ হিজরি সনের জিলকদ মাসে হুদাইবিয়ার অভিযান সংঘটিত হয়। ১৪০০ সাহাবিসহ নবী করিম (সা.) ওমরাহ পালনের জন্য মক্কায় রওনা হন। কিন্তু জেদ্দা থেকে মক্কাগামী পথের পাশে হুদাইবিয়া নামক স্থানে মুশরিকদের দ্বারা তিনি বাধাপ্রাপ্ত হলে মক্কায় পৌঁছে ওমরাহ পালন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ওই স্থানের সানিয়াতুল মিরারে নামক স্থানে তাঁর উট বসে যায়। অপরদিকে কুরাইশদের পক্ষ থেকেও সামরিক অভিযানের হুমকি আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কুরাইশদের পক্ষ থেকে সুহায়ল ইবনে আমরকে দূত হিসেবে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কুরাইশদের সঙ্গে বেশ ক’টি শর্ত নিয়ে সমঝোতা করেন। শর্তগুলোই হুদাইবিয়ার সন্ধি হিসেবে পরিচিত। পবিত্র কোরআনের সুরা ফাতেহতে এই সন্ধিকে প্রকাশ্য বিজয় হিসেবে অভিহিত করা হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোমলমতি ছাত্রদেরও এটি মনে রাখতে হবে যে, কোনো কিছু বলা মাত্রই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সব কাজের জন্যই অন্তত নিয়মমাফিক সময় লাগে। আর সে কাজটি করতে হলে কাজের অনুপাতে সময়ও দিতে হয়।

দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দু-চার দিন বা দুই সপ্তাহের মধ্যে সমাধানযোগ্য নয়। এর সঙ্গে রয়েছে পরিবহন মাফিয়াদের নেওয়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ঋণ। গত শুক্রবার (৩ আগস্ট) দৈনিক বাংলাদেশের খবরে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুসারে পরিবহন ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি হয়ে আছেন। দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিগগিরই এসব পরিবহন মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরিবহন ব্যবস্থায় নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ দেশের সাধারণ মানুষ। যাত্রী কল্যাণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেয়েছে। আইন প্রয়োগে উদ্যোগ নিলেই পরিবহন মাফিয়া চক্র অবরোধ বা ধর্মঘট ডেকে সাধারণ মানুষ এমনকি সরকারকেও জিম্মি করে। ফেডারেশনের নামে, শ্রমিকদের স্বার্থের কথা বলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ইচ্ছে মাফিক নিয়ম চালু, যাত্রীদের সঙ্গে অন্যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার ঋণ, সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে প্রতিদিন মানুষ মারা নৈমিত্তিক নিয়মে পরিণত করেছে পরিবহন মাফিয়ারা।

পরিবহন ব্যবসায় জড়িত ক্ষমতাসীন দলের নেতৃস্থানীয়রা। আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও পরিবহন ব্যবসায়ীদের মাঝে রয়েছে বিশাল অনিয়মের কোটি টাকার লেনদেন। গোপন টোকেনে চলে ফিটনেস আর লাইসেন্স ছাড়াই লাখ লাখ গাড়ি। মালিকদের সময় বেঁধে দেওয়ার চাপে আপ ট্রিপ আর ডাউন ট্রিপের প্রতিযোগিতায় গাড়ি চলে বেপরোয়া গতিতে। মাত্র ৫৫ হাজার ৫৯৮ বর্গ কিলোমিটারের বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষকে প্রাণ হারাতে হয় চালক নামের আরেক মানুষের হাতে। এই চালকরাই গত ১৫ বছরে ৫৫ হাজার নিরপরাধ মানুষের প্রাণ সংহার করেছে! এসব মৃত্যু হত্যা নাকি দুর্ঘটনা, তাও নিরূপণ করার জো ছিল না! সবই দুর্ঘটনা বলে পার পেয়ে গেছে ওরা। সরকারেরও যেন গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল! বিচার হয়নি! এতদিন এ যেন কেউই দেখার ছিল না!

সময় বদলেছে বিশ্বায়নের বাংলাদেশ গ্রামে, গড়ে উঠেছে প্রতিবাদের সুর। যাদের হাত ধরে আগামীর বাংলাদেশ তারা এগিয়েছে অনেকদূর। এ প্রজন্ম আর পরিবহন মাফিয়াদের অন্যায় সহ্য করবে না। আঠারো কোটি মানুষকে সাক্ষী রেখেছে তরুণরা। তারাই পারবে হাজারো অনিয়মকে নিয়মে ফেরাতে। গত এক সপ্তাহের ছাত্র আন্দোলন তারই প্রমাণ। এবার তরুণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলব- অর্জন তোমাদের অনেক হয়েছে, তোমরা বিজয়ী। রাজপথে আর নয়, এবার ক্লাসে ফেরার পালা। কারণ, আগামীর বাংলাদেশ তোমাদেরই অপেক্ষায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads