• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
‘তিন বছরে তোমাদের কিছুই দেবার পারব না’

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সংরক্ষিত ছবি

সংবাদ-ভাষ্য

‘তিন বছরে তোমাদের কিছুই দেবার পারব না’

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১০ জানুয়ারি ২০১৯

১৯৭২ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় বিশ্ব বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন লিখেছিল, A new country Bangladesh begins with a lot of ‘Rampage and rap of Bangladesh economy’ by Pakistani occupation force একই সময়ে কুখ্যাত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লুণ্ঠন, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপকর্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষ পরিদর্শক টিম তার রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, Some cities of Banglsdesh looked like the morning after a nuclear attack. একই রিপোর্টে বলা হয়েছে, অন্ততপক্ষে ৬০ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, ১৪ লাখ কৃষক পরিবার হারিয়েছে তাদের জমি চাষ করার গরু, লাঙ্গল ও অন্যান্য কৃষি সরঞ্জাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নৌপথের যাতায়াত ব্যবস্থাও ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ।

বস্তুত ২৫ মার্চ টিক্কা-ইয়াহিয়া কুখ্যাত সামরিক চক্র বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) ঘৃণিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে যে ধ্বংসলীলা শুরু করেছিল, তার প্রতিউত্তরে ঘুমন্ত বীর বাঙালি  ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের মতো ফুঁসে উঠেছিল। তখন থেকেই পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল এই যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই তারা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছিল এবং ১ কোটি মানুষকে নিজেদের পিতৃপুরুষের ভিটা থেকে উচ্ছেদ করে দেশান্তরি হতে বাধ্য করেছিল। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনেও যুদ্ধকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছিল কেবল বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সব সম্পদ এবং অর্থনৈতিক স্থাপনা পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাকিস্তানের যতগুলো বাণিজ্যিক স্থাপনা ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ও লাভজনক ছিল পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ)। টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পিআইএ’র সব সম্পদ নিয়ে গেছে। কেবল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পিআইএ’র একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১৬ ডলারের সমপরিমাণ ১১৭ টাকা জমা ছিল। পাকিস্তানি বর্বর সেনারা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের নোট ও কয়েন ধ্বংস করে দিয়েছে। এমনকি তারা শোরুমের গাড়িগুলো ছাড়াও রাস্তায় চলাচলকারী প্রাইভেট গাড়িগুলো বাজেয়াপ্ত করে জাহাজ বোঝাই করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দাম ও বর্বর হানাদার বাহিনীর কুকর্মের জরিমানা ছাড়াই সুদে-মূলে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের কাছে আমাদের পাওনা লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের আজকের দিনে স্বদেশের পবিত্র জমিতে পা রেখেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধকে ‘Biggest human disaster in the world’ আখ্যায়িত করে দাবি করেন- এই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং সম্ভ্রম হাড়িয়েছে ২ লাখ মা-বোন।

খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, ব্যাংকগুলো শূন্য, কলকারখানা বন্ধ, পাক-বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইনে বন্দরে জাহাজ চলাচল বন্ধ, এমনি এক রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ ও সর্বগ্রাসী ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘আগামী তিন বছরে আমি তোমাদের কিছু দেবার পারব না।’ হিমালয়ের শীর্ষ চূড়ার মতো আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয় ও সুতীব্র অহংকার ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু যখনই তার সা’দাত আঙুলের ইশারায় এদেশের মানুষকে নির্দেশনা দিয়েছেন, লক্ষ কোটি জনতা কখনো রেসকোর্সে, কখনো পল্টনে, কখনো আরমানিটোলায়, আবার কখনো বাহাদুর শাহ পার্কে গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে তার নির্দেশ মেনে নিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে যখন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন তিনি তিন বছরে কিছুই দিতে পারবেন না, সব মানুষ নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষ জঠরজ্বালা নিয়ে নিশুতি রাতে ঘুমাতে গেছে। সর্বনাশা দুর্ভিক্ষকে বুক পেতে আলিঙ্গন করেছে। তবু বঙ্গবন্ধুর ওপর তাদের বিশ্বাস, আস্থা ও নির্ভরতাকে এতটুকু কলুষিত হতে দেয়নি।

বঙ্গবন্ধু কিছুই দেবেন না বলেছিলেন। কিন্তু তিনি চুপ করে বসে থাকেননি, এক এক করে সাফল্য যোগ হতে লাগল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙালি জাতির জীবনে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর শুভ জন্মদিন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলায় তার প্রথম জন্মদিনের প্রথম প্রহরের আগেই ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে তাদের স্বদেশে পাঠিয়ে সারা বিশ্বকে বঙ্গবন্ধু চমকে দিয়েছিলেন। আজ প্রায় ৭৫ বছর হলো আমেরিকান মিত্রবাহিনী জাপানে অবস্থান করছে। দেশে ফেরার কোনো উদ্যোগ নেই। জাপান কেন, পৃথিবীর অনেক দেশই মিত্রবাহিনী আমন্ত্রণ করে এনে আর সহসা ফেরত পাঠাতে পারেনি। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ সেই বোঝা তাদের টানতে হয়েছে। কেবল ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। জাতির জনকের ঐন্দ্রজালিক রাষ্ট্রনায়কত্বের জোরেই বাংলাদেশ সসম্মানে মিত্রবাহিনীকে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে।

মাত্র এক বছর না ঘুরতেই জাতিকে উপহার দিয়েছেন একটি পূর্ণাঙ্গ শাসনতন্ত্র। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বর্ম দিয়ে সিল করা ’৭২-এর এই সংবিধানকে বলা হয় আধুনিক বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শাসনতন্ত্র। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল লক্ষ্যই ছিল শোষণ-বঞ্চনাহীন একটি সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ বিনির্মাণ। এই লক্ষ্য অর্জনে বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী শোষণ থেকে জাতিকে সুষম-সহনশীল নিষ্পেষণমুক্ত সমাজ উপহার দেওয়ার জন্য স্বাধীনতার উষালগ্নেই তিনি মিল-কারখানা জাতীয়করণ করে পুঁজিবাদের মাজা ভেঙে দিয়েছিলেন। এক কোটি বাস্তুভিটাত্যাগী শরণার্থীকে পুনর্বাসন ও ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতিকে সঠিক স্থানে প্রতিষ্ঠিত করার সঙ্গে সঙ্গে মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তিনি প্রণয়ন করেছিলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা।

বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল দিকটি ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব—কারো প্রতি বৈরিতা নয়’ এই আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক সাফল্য অর্জন করেছেন। একদিকে তিনি পঁচিশ বছরের ‘Indo-Bangladeshi Treaty of Friendship, Cooperation and Peace’ (যা ‘মুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তি নামে সর্বাধিক পরিচিত)-এর মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করেছিলেন। অপরদিকে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু লাহোরে অনুষ্ঠিত ‘Organisation of the Islamic Confeerence’ বা ওআইসির সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে একাধারে পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভ করেন, অপরদিকে ওআইসি ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করার গৌরব অর্জন করেন। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ লাভ করে কমনওয়েলথ ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (Non-Aligned Movement)-এর সদস্যপদ। শুধু সদস্যপদ অর্জন নয়, অতি দ্রুত বঙ্গবন্ধু এসব আন্তর্জাতিক জোটের অন্যতম নেতা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের একই ফ্রেমে স্থান করে নেন বঙ্গবন্ধু। জাতিসংঘের সদস্যপদ ছাড়াও পৃথিবীর প্রায় সব দেশ (সৌদি আরব, সুদান, ওমান, চীন ছাড়া) বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, এক কোটি বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন, আন্তর্জাতিক সুনাম সুখ্যাতি অর্জন ছাড়াও জাতির জনক দেশের রাজনীতিতে একটি সুস্থধারা সৃষ্টির লক্ষ্যে গ্রহণ করেছিলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সবারই জানা আছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও তার নিয়ন্ত্রিত গণবাহিনী, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি, তথাকথিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের নামে বিভিন্ন কিসিমের লাল পতাকা, নীল পতাকাধারী হঠকারী অপশক্তি। এসব বিভ্রান্ত ও বিপথগামীর হাতে অন্তত পঞ্চাশ হাজার রাজনৈতিককর্মী মৃত্যুবরণ করেন। এসব নাশকতা ও নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীর হাত থেকে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও জাতীয় রাজনীতিতে সুস্থির ধারা প্রবর্তনের লক্ষ্যে জাতির জনক অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গঠন করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল। একশ্রেণির তথ্য-সন্ত্রাসী বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে একদলীয় শাসন নামে অপপ্রচার চালিয়ে তাকে খাটো করা ও চরিত্র হননের চেষ্টা করেছে। একদলীয় শাসন কায়েম করতে চাইলে বঙ্গবন্ধু সব দল নিষিদ্ধ করে তার হাতে গড়া প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখতেন। বাকশাল ছিল জাতীয় রাজনীতির মেরুকরণের একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে তিনি দেশের সব রাজনৈতিক শক্তিকে একটি প্ল্যাটফর্মে একীভূত করে স্বাধীনতার মূল চেতনা ও লক্ষ্যের দিকে জাতিকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। এজন্যই সব বামপন্থি, ডানপন্থি, মধ্যপন্থি ও লিবারেল রাজনৈতিক শক্তি, দলমত নির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুর এই নতুন রাজনৈতিক পদক্ষেপকে সর্বতোভাবে সমর্থন করেছিলেন। সব দলের, সব মতের, সব পথের রাজনীতিকরা স্বেচ্ছায় এই পদক্ষেপের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার এদেশীয় এজেন্ট জাতির জনককে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে ইতিহাসের কাঁটা থমকে দাঁড়ায় ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের বাসভবনে। ঘাতকের কালো মেশিনগানের নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে মানবসভ্যতা। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি হতেন সব সময়ের বিশ্ববরেণ্য নেতাদের কাতারে অন্যতম সহযাত্রী। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমরা হারিয়েছি আমাদের নেতাকে, আমাদের অভিভাবককে। জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা ও তার আদর্শের নির্ভেজাল অনুসারী শেখ হাসিনা আজ জাতির সার্থক কাণ্ডারি হয়ে এ জাতির হাল ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে আমরা নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। সেখান থেকে জাতিকে শেখ হাসিনা মুক্ত করেছেন। আমরা আশা করব বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে জাতি অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছিল, জাতির জনকের কন্যা আমাদের সেই অভাবও পূরণ করবেন। আজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে এটাই জাতির প্রত্যাশা।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads