পলান সরকার। একজন ‘সাদা মনের মানুষ’। একজন আলোর ফেরিওয়ালা। বার্ধক্যের কারণে ৯৮ বছর বয়সে নিজ বাড়িতে গত শুক্রবার মারা যান তিনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে রাজশাহীর বাঘা থানার বাউসা গ্রামে। গতকাল শনিবার সকালে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় বিদায় জানানো হয় একুশে পদকপ্রাপ্ত এ আলোর ফেরিওয়ালাকে।
এর আগে, সকাল ৯টা ৩০ মিনিটের দিকে পলান সরকারের মরদেহ নেওয়া হয় তার প্রতিষ্ঠিত বাউসা গ্রামের হারুনুর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। এ সময় জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন বয়সের বইপ্রেমী, গ্রামবাসী, শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা শেষবারের মতো ফুলেল শ্রদ্ধা জানান তাকে। পলান সরকারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন জেলা প্রশাসক আবদুল কাদের, পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহসহ অনেকে। পরে সকাল ১০টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে স্ত্রী রাহেলা বিবির কবরের পাশে দাফন করা হয় এ বইপ্রেমীকে। ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পলান সরকার। তার আসল নাম হারেজ উদ্দিন সরকার হলেও জন্মের পর থেকেই তার মা ‘পলান’ নামে ডাকতেন। পলান সরকারের বাবার নাম হায়াত উল্লাহ সরকার, মায়ের নাম মইফুন নেসা। মাত্র পাঁচ মাস বয়সে বাবাকে হারান তিনি। অর্থনৈতিক সঙ্কটে ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করেই আটকে যায় তার শিক্ষাজীবন। তারপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজশাহীর বাঘা থানার বাউসা গ্রামের নানা বাড়িতেই থাকতেন তিনি। শিক্ষাজীবন বন্ধ হয়ে গেলে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন পলান সরকার। ১৯৯০ সাল থেকে তার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ শুরু করেন তিনি। তারপর থেকে গ্রামের মানুষজনও তার কাছে বই চাইতে শুরু করেন। এভাবেই শুরু হয় তার বই পড়া আন্দোলনের ভিত। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে পলান সরকার হেঁটে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া এবং ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে বই দেওয়া শুরু করেন তিনি।
২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে পলান সরকারের বই পড়া আন্দোলনের কথা জানতে পারে পুরো দেশ। আলোর ফেরিওয়ালা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।
তারপর ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। ২০১১ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন পলান সরকার। ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পলান সরকারের জীবনের ছায়া অবলম্বনে গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন বিশেষ নাটক ‘অবদান’।
বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সবার মাঝে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য পলান সরকারকে ‘সাদা মনের মানুষ’ খেতাবে ভূষিত করে ইউনিলিভার বাংলাদেশ।