• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

পর্যবেক্ষণ

গৃহবন্দি বিশ্ববাসী

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ১৫ মার্চ ২০২০

করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন কমে এলেও বেড়ে চলেছে বিশ্বের সর্বত্র। করোনার কারণে অচল হয়ে পড়েছে সবকিছু। বিশ্বের বড় বড় চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এ ভাইরাস যেন দিনকে দিন আরো জোরালো হয়ে উঠছে। করোনার কারণে যে চীন দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে অনেকটা ‘একঘরে’ হয়েছিল সেই দেশটির ওপরই এখন নির্ভর করতে হচ্ছে অনেক দেশকে। চিকিৎসা সরঞ্জাম, মাস্ক এবং অভিজ্ঞ মেডিকেল টিম দিয়ে করোনা আক্রান্ত অনেক দেশকে সহযোগিতা করছে চীন। খবর: বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার।

তার পরও বেড়েই চলেছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। প্রতিদিনই নতুন নতুন দেশে করেনা আক্রান্ত রোগীর কথা জানা যাচ্ছে। এই ভাইরাসের আক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওমিটারসের ওয়েবসাইট অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১৪৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে করোনা। আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৮২৫ জন মানুষ। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৫ হাজার ৪৩৮ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৭২ হাজার ৫৫০ জন।

গত দুই সপ্তাহে ভাইরাসটি চীনের বাইরে ১৩ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে বুধবার পৃথিবীব্যাপী মহামারি ঘোষণা করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন। উৎপত্তিস্থল চীনে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হলেও সেখানে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব কমে গেছে। শনিবার বিশ্বে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৩৫৩ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১০৭ জন আক্রান্ত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয়েছে ৮২ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে নতুন করে মৃত্যুর সংখ্যা ২২। চীনে ১৩, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫, যুক্তরাষ্ট্রে ১ ও ফিলিপাইনে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চীনের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ইতালিতে। দেশটিতে ১৭ হাজার ৬৬০ জন মানুষ আক্রান্ত হওয়ার বিপরীতে মারা গেছেন ১ হাজার ২৬৬ জন। ইরানে ১১ হাজার ৩৬৪ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আর মারা গেছে ৫১২ জন। দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮ হাজার ৮৬ জন আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৭২ জন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় এ রোগ সামাল দিতে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে ভাইরাস মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তায় জরুরি ত্রাণ তহবিলের ৫০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করতে পারবেন ট্রাম্প।

এ ছাড়া এতে মেডিকেল ইনস্যুরেন্সের ওপর আরোপিত নিয়মনীতি শিথিল এবং নতুন হাসপাতাল তৈরি ও ভাইরাসের নতুন ধরনের চিকিৎসা অনুসন্ধানের পথ খুলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৭০১ জন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। নতুন করে সংক্রমণ রোধে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বড় ধরনের জনসমাগম, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও স্কুল বন্ধসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস মোকাবেলায় জরুরি অবস্থা জারির পর এ প্রথম বিশ্বজুড়ে হুমকি হয়ে দাঁড়ানো কোনো রোগ সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে এ আদেশ দিতে হলো। তার আগে আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে।

এদিকে চীনের পর ইউরোপ করোনা প্রাদুর্ভাবের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও-হু)। এর মধ্যে ইতালির পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। হুর প্রধান ড. টেড্রস আধানম গেব্রেইয়েসাস বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনার মহামারির কেন্দ্র এখন ইউরোপ। তিনি দেশগুলোর সরকারকে মানুষের জীবন বাঁচাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, সংহতি রাখা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এ আগুনকে আর জ্বলতে দেবেন না।

ইতালির পর ইউরোপের আরেক দেশ স্পেনের পরিস্থিতি খারাপ। সেখানে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়ে ১২০-এ দাঁড়িয়েছে। মোট আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ২৩১ জন। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো স্যানচেজ দুই সপ্তাহের জন্য রাষ্ট্রীয় সতর্কতা ঘোষণা করেছেন। স্পেনের পরের অবস্থানে রয়েছে ফ্রান্স। সেখানে শুক্রবার ৬১ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯। আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৭৬ জন। জার্মানিতে মোট আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩ হাজার ৬২। মারা গেছে পাঁচজন। ব্রিটেনে আক্রান্ত হয়েছে ৭৯৮ জন এবং মারা গেছে ১১ জন।

ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ায় এ সংখ্যাকে মর্মান্তিক মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছেন ড. টেড্রস।  বলেন, চীন ছাড়া এখন বিশ্বের বাকি দেশগুলো মিলিয়ে যতসংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশিসংখ্যক শুধু ইউরোপেই হচ্ছে। চীনে প্রাদুর্ভাবটির উচ্চ হারের সময়ে দিনে যতসংখ্যক আক্রান্ত হতো, ইউরোপে এখন তার চেয়ে বেশিসংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে। ডেনমার্ক, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের কমপক্ষে ১০টি দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানির কিছু অংশে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বড় সমাগম বাতিল এবং থিয়েটার, রেস্টুরেন্ট ও বার বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের পরিস্থিতির চেয়েও ইউরোপের অবস্থা বেশি খারাপ। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর ঘিরেই করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ কারণে শুধু সে শহরের দিকেই সব পক্ষের মনোযোগ ছিল। চীন সরকার উহানকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখে। করোনা ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ইউরোপের দেশগুলো ভাইরাসটি মোকাবেলায় একেবারেই ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। শনাক্ত হওয়ার সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এসব পরিসংখ্যান বের করা হয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের শঙ্কা, নজর দেওয়া হচ্ছে না, এমন দেশগুলোয় বড় আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে ভাইরাসটি।

করোনার বিস্তার রোধে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, আজ (রোববার) মধ্যরাত থেকে তার দেশে আসা প্রায় প্রত্যেককে অবশ্যই সেলফ-আইসোলেট হতে হবে। গতকাল শনিবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন তিনি। বলেন, করোনা প্রতিরোধে তার সরকারের নেওয়া এ নতুন পদক্ষেপ নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীদের জন্যও প্রযোজ্য হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ছাড় পাবেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা। কারণ, সেখানে এখন পর্যন্ত এ ভাইরাস হানা দেয়নি।

অন্যদিকে আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল অংশজুড়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। শনিবার নাইন নিউজ ও আল-আরাবিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকে যেন অনেকটা বেঁচেই যাচ্ছিল দুঃখ-দুর্দশায় বিপন্ন আফ্রিকা। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লেও এ মহাদেশটিকে অনেকটা ছাড় দিয়ে চলছিল করোনা। কিন্তু এবারে ওই অঞ্চলের দিকেও থাবা বাড়াতে শুরু করেছে এ ভাইরাস। এরই মাঝে আফ্রিকার ১৯টি দেশ এতে আক্রান্ত হয়েছে।

গত কয়েক দিনে কেনিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, মৌরিতানিয়া ও গিনি নিজেদের দেশে করোনা আক্রান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছে। এর আগে মরক্কো, তিউনিসিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, সেনেগাল, টোগো, ক্যামেরুন, বুরকিনা ফাসো, কঙ্গো, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, ঘানা, গেবনেও করোনা প্রবেশ করে।  যদিও বেশির ভাগ দেশেই এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দশের নিচে। এবং আক্রান্তরা বেশির ভাগই বিদেশি অথবা বাইরে ভ্রমণকারী।

করোনা ছড়িয়ে পড়া রোধের চেষ্টায় আক্রান্ত ও সন্দেহভাজনদের এখন পর্যন্ত দ্রুত পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হলেও, এর প্রকোপ বেড়ে গেলে আফ্রিকার মতো বিপন্ন একটি মহাদেশ তা কীভাবে মোকাবেলা করবে এ নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও ইয়েমেন ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ১৩টি দেশে করোনা প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে আছে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, ইসরাইল, ফিলিস্তিন, লেবানন, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ইরান। এরপরই আছে বাহরাইন ও কুয়েত।

এছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দুই সপ্তাহের জন্য আন্তর্জাতিক সব ফ্লাইট বাতিল করেছে সৌদি আরব। দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা এসপিএ শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আজ (রোববার) থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ ফ্লাইট বাতিল থাকবে। ফ্লাইট বাতিল হওয়ার কারণে সৌদির যেসব নাগরিক বা দেশটির বাসিন্দারা ফিরতে পারবেন না, তাদের জন্য সে সময়টা বিশেষ সরকারি ছুটি হিসেবে গণ্য করা হবে। সৌদিতে ফেরার পরে যাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে, তারাও এ রকম বিশেষ ছুটি পাবেন। দেশটিতে এ পর্যন্ত ৮৬ জন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা গেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads