• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

পৈশাচিক গণহত্যার কালো অধ্যায়

  • প্রকাশিত ২৫ মার্চ ২০১৮

পেছনে ফেলে এসেছি আমরা সাতচল্লিশ বছর। ভুলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময়। আমাদের বলা হয় বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। আমরা অনেক কিছুই মনে রাখি না। ব্যক্তির বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারার ব্যর্থতার কারণে আমরা এই ভূখণ্ডের বৃহৎসংখ্যক মানুষের মনের কথাগুলো ভুলে থাকতে পছন্দ করি। ফলে নানামুখী ভাবনাচিন্তার জট আমাদের মধ্যে ঘুরপাক খায়, আমরা ভুলে যাই পেছনের পথ। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিভ্রান্ত করার মানুষও রয়েছে। তারা ঘাপটি মেরে থেকে দীর্ঘদিন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আমাদের তলিয়ে দিচ্ছিল বিস্মৃতির অতলে। আর এতে করে আমরা ভুলে যাচ্ছিলাম মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনকে ধীরে ধীরে করে তোলা হচ্ছিল বিতর্কিত। আমাদের চিন্তাকে ধাপে ধাপে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের অর্জন থেকে। ইতিহাসের অপব্যবহার, আর রাজনৈতিক শক্তির বলয়কে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হচ্ছিল সঙ্কট। যাতে করে মানুষ ভুলে যায় নিজের শ্রেষ্ঠ অর্জনকে। দীর্ঘ চার দশক ধরে দেশের মানুষকে এমনি একটি শৃঙ্খলের মধ্যে বেঁধে রাখার চেষ্টা হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এলেই বিভ্রান্তিকর অথবা কথাবার্তার ভেতর দিয়ে মুক্তবুদ্ধির মানুষকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব এখন আমাদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। অথচ এখনো কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা বিভ্রান্তিকে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। তাদের ভেতরে যে ভ্রান্ত চিন্তার জট পাকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারিনি।

আমরা মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলাম সাম্প্রদায়িকতা থেকে। আমাদের ছোট্ট এই ভূখণ্ডের ভেতরে হাজার বছর ধরে নানা সম্প্রদায়, নানা ধর্মের মানুষের বাস। পাশাপাশি সহাবস্থানের ভেতর দিয়েই তাদের জীবনযাত্রা। যা কখনোই হিংসাশ্রয়ী ছিল না। কারণ হিংসার ছোবল যদি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখত তাহলে কখনোই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠতে পারতাম না। ফলে আমরা একাত্তরে এসে সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ আর ধনী-গরিবের সমস্ত অসঙ্গতিকে বলিষ্ঠভাবে না বলবার সাহস অর্জন করেছিলাম। আর সেই সাহসে বলীয়ান হয়েই বাঙালি মুক্তির লড়াইয়ের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত ও সমর্পণ করেছে।

এই প্রস্তুতির মূহূর্তে আমাদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসে উনিশ শ’ একাত্তর সালের পঁচিশ মার্চ রাতে। ইতিহাসের কালো অধ্যায় এই রাত। আমাদের স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে দলে-মুচড়ে দিতে চেয়েছে। সচেতনভাবে ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পৈশাচিক পন্থায় নির্মূল করতে চেয়েছে এই জাতিকে।  ইতিহাসের পাতায় সেই নির্মমতা, পৈশাচিক গণহত্যার দৃষ্টান্ত বিরল।

গণহত্যার ভয়াবহতা যুগে যুগে অনেক জাতিকেই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। সম্রাট অশোকের শাসনামলে কলিঙ্গের যুদ্ধে তেমনি মঙ্গল নেতা হালাকু খানের ইরাক আক্রমণেও গণহত্যার সাক্ষ্য মেলে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগেও চালানো হয়েছিল গণহত্যা। তাই গ্রিক শব্দ Genos এবং ল্যাটিন শব্দ Cide মিলে ঠিক কবে ইংরেজি প্রতিশব্দ Genocide হয়েছে, তার ঠিকুজি না মিললেও গণহত্যার সাক্ষী হয়ে রয়েছে বিশ্বের অনেক জাতি। আর এইসব গণহত্যার সবচেয়ে বড় ভয়াবহতা এবং নৃশংসতা আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে।

যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগানে গলা কাঁপিয়েছিলাম, ভাগ হয়েছিল ভারতবর্ষ—  সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান-  সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। আর তাই আমরাই আবার স্লোগান তুলতে বাধ্য হয়েছি— ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’। এই নতুন ঠিকানা খুঁজতে যাওয়ার প্রয়োজনে যখন আমরা অন্যায় এবং শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম, তখন বন্দুকের নলে আমাদের থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিল যুদ্ধ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠার  যুদ্ধে বাঙালির বিজয়কে থামিয়ে দিতে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশজুড়ে চালানো হয় নৃশংস হত্যাকাণ্ড।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর গ্রহণ করা রেজুলেশন অনুযায়ী, গণহত্যা বলতে বোঝানো হয় এমন কর্মকাণ্ড যার মাধ্যমে একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সরকার এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে এই ভূখণ্ডের জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্যোগ নিয়েছিল। যার বাস্তবায়ন করে তারা নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। উনিশ শ’ একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে পরিকল্পিতভাবে বাঙালি নিধনের যে নীল নকশা তৈরি করা হয়েছিল, বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় নয় মাস ধরে গণহত্যা চালানো হয়।

সারা দেশে চালানো ১৯৭১ সালের গণহত্যার সাক্ষী আমাদের অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল-জলাশয়। কারণ, নদীতীরে, জলাশয়ের পাশে নিয়ে সার বেঁধে অধিকাংশ সময় হত্যা করা হয়েছে নিরীহ মানুষদের। যাতে মৃতদেহগুলো নদী-জলাশয়ের পানিতে হারিয়ে যায়। আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে ঘিরে। নদীর দুপাড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনপদ, নগর, বন্দর। পাকিস্তানি বাহিনী তাই নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদগুলোতেই তাদের নৃশংসতা চালিয়েছে বেশি। নদী তীরবর্তী জনপদের অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। পুরো বাংলাদেশকে রঞ্জিত করা হয়েছে রক্তে। নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ইতিহাসের ঘৃণিত অধ্যায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুধু গণহত্যা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ জনপদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, এসব এলাকার অসংখ্য মা-বোনকে নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে-নৃশংসতায় নিহত অধিকাংশের নাম-ঠিকানা আজো আমাদের কাছে অজানা। অনেক বধ্যভূমি এবং গণকবরের সন্ধান মিললেও গড়ে ওঠেনি স্মৃতিস্তম্ভ। স্বজন হারানো মানুষেরা পায়নি তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনের মৃতদেহ। কিন্তু ইতিহাসের সেই ভয়াবহতার চিহ্ন তো আজো ধারণ করে আছে এই বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা নিয়ে সচেতনভাবে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র যে নৈরাশ্যের সুর আমাদের ওপর দীর্ঘদিন চাপিয়ে রেখেছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের যে অসম্মানের তীক্ষ বেদনায় বিদ্ধ করেছিল— সে অবস্থার তো পরিবর্তন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করে রাখার যে চেষ্টা হয়েছিল, তার বিস্তার থেমে গেছে তারুণ্যের জাগরণে। আজ সাতচল্লিশ বছর পরে এসেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই হচ্ছে। নতুন নাম যোগ হচ্ছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বাদ পড়ছে। এই ইতিবাচক চিন্তার ভেতর থেকেই এখন আমাদের গণহত্যায় শহীদ স্বজনদের নাম তালিকাবদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। রাষ্ট্রের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন কঠিন নয়। আমাদের শহীদের সংখ্যা নিয়ে আজো যেসব ঘৃণিত মানুষ সংশয় প্রকাশের সুযোগ খোঁজে— গণহত্যায় শহীদ আমাদের স্বজনদের চিহ্নিত করে যথাযথভাবে তাদের নামের তালিকা প্রস্তুত হলে— তা হবে আমাদের সামনে বলিষ্ঠ উদাহরণ। একইভাবে স্বজন হারানো সেইসব পরিবার শহীদ পরিবার হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ফিরে পাবে সম্মান। আর পরাজয়ের বেদনায় যে অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করতে যেসব বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তারও মীমাংসা হয়ে যাবে। 

 

লেখক : মামুন রশীদ (সাংবাদিক, কবি)

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads